
ডায়াবেটিস মেলাইটাস কিছু রোগকে বোঝায় যেগুলো আপনার শরীর কিভাবে রক্তের শর্করাকে ব্যবহার করবে সেটিকে প্রভাবিত করে। আমাদের শরীরের জন্য গ্লকোজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারন এটি আমাদের পেশী এবং কোষের প্রয়োজনীয় শক্তি জুগিয়ে থাকে। এছাড়া গ্লকোজ আপনার মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় শক্তির প্রধান উৎস।
ডায়াবেটিস হওয়ার কারন এই রোগটির প্রকারভেদের উপর নির্ভর করে। তবে আপনার যে ধরনের ডায়াবেটিস হয়ে থাকুক না কেনো এটি আপনার রক্তে শর্করার পরিমান বাড়িয়ে দিবে। আপনার রক্তে শর্করার পরিমান অতিরিক্ত হয়ে থাকলে তা গুরুতর জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।
দীর্ঘ মেয়াদী ডায়াবেটিস দু রকম হয়ে থাকেঃ টাইপ ১ ডায়াবেটিস এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস। রিভারসেবল ডায়াবেটিসের মধ্যে রয়েছে প্রিডায়াবেটিস এবং জেসটেশনাল ডায়াবেটিস। আপনার রক্তে শর্করার পরিমান স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী থাকলে একে বলা হয় প্রিডায়াবেটিস তবে এই মাত্রাকে ডায়াবেটিস বলা যাবে না। তবে, সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহন না করলে প্রিডায়াবেটিস ডায়াবেটিসে পরিণত হতে পারে। জেসটেশনাল ডায়াবেটিস গর্ভাবস্থায় হয়ে থাকে তবে তা সন্তান জন্মের পর নিরাময় হতে পারে।
উপসর্গসমূহ
আপনার রক্তে শর্করার পরিমান কী পরিমানে বৃদ্ধি পেয়েছে সেটার উপর ডায়াবেটিসের উপসর্গগুলোর তারতম্য হয়ে থাকে। বিশেষ করে প্রিডায়াবেটিস অথবা টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের মধ্যে কোন উপসর্গ না ও থাকতে পারে। টাইপ ১ ডায়াবেটিসে উপসর্গগুলো দ্রুত আবির্ভূত হয় এবং জটিল আকার ধারন করতে পারে।
টাইপ ১ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের কিছু উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
- তৃষ্ণা বেড়ে যাওয়া
- ঘন ঘন মুত্রত্যাগ
- ক্ষুধা প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পাওয়া
- কারন ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া
- প্রস্রাবে কিটোনের উপস্থিতি (কিটোন হচ্ছে পর্যাপ্ত ইনসুলিনের অভাবে পেশী এবং চর্বি ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট এক ধরনের উপজাত)
- ক্লান্ত বোধ করা
- অস্বস্তি
- দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া
- ঘা সহজে না শুকানো
- ঘন ঘন সংক্রমন হওয়া যেমনঃ মাড়িতে, ত্বকে অথবা যোনিতে
টাইপ ১ ডায়াবেটিস যে কোন বয়সে হতে পারে যদিও এটি শিশুকালে অথবা কৈশোরে হয়ে থাকে। টাইপ ২ ডায়াবেটিস সচরাচর দেখা যায় এবং এটি যে কোন বয়সে হতে পারে যদিও ৪০ বছরের বেশী বয়সীদের মধ্যে এই রোগটি বেশী দেখা যায়।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন
- যদি আপনার সন্দেহ হয় যে আপনি অথবা আপনার সন্তান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। যদি আপনি ডায়াবেটিসের কোন উপসর্গ লক্ষ্য করে থাকেন তবে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। যত আগে রোগটি শনাক্ত হবে ততো তাড়াতাড়ি চিকিৎসা আরম্ভ করা যাবে।
- যদি আপনার ইতিমধ্যেই ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়ে থাকে। ডায়াবেটিস শনাক্ত হওয়ার পর আপনার রক্তে শর্করার পরিমান স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে চিকিৎসকের সাথে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রাখতে হবে।
কারনসমূহ
ডায়াবেটিসকে বুঝতে হলে আপনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে কিভাবে শর্করা আমাদের শরীরে স্বাভাবিকভাবে প্রক্রিয়া হয়ে থাকে।
যেভাবে ইনসুলিন কাজ করে
আমাদের পাকস্থলীর পেছনে এবং নীচে অবস্থিত একটি গ্রন্থি (অগ্নাশয়) থেকে ইনসুলিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়ে থাকে।
- অগ্নাশয় রক্তে ইনসুলিন নিঃসরণ করে।
- ইনসুলিন রক্তে মিশে যাওয়ার ফলে শর্করা আমাদের কোষে প্রবেশ করতে পারে।
- ইনসুলিন আপনার রক্তে শর্করার পরিমান কমিয়ে দেয়।
- আপনার রক্তে শর্করার পরিমান কমার সাথে সাথে আপনার অগ্নাশয় থেকে ইনসুলিনের নিঃসরণ ও কমে যায়।
গ্লকোজের ভূমিকা
আমাদের কোষসমূহ কে পেশী এবং অন্যান্য অংগ তৈরিতে শক্তি যোগায় গ্লকোজ যেটি একধরনের চিনি।
- গ্লকোজের অন্যতম প্রধান দুটি সুত্র হলোঃ খাবার এবং আপনার যকৃৎ।
- শর্করা আমাদের রক্তে শোষিত হয়ে থাকে যেখানে এটি কোষের মধ্যে ইনসুলিনের সহায়তায় প্রবেশ করে।
- আমাদের যকৃতে গ্লকোজ তৈরি হয় এবং জমা হয়।
- আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা যখন কম থাকে যেমন আপনি যখন কিছু সময় না খেয়ে থাকেন আমাদের যকৃৎ সেখান জমাকৃত গ্লাইকোজেনকে ভেঙ্গে গ্লকোজে পরিণত করে এবং এর মাধ্যমে আমাদের রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যায়।
টাইপ ১ ডায়াবেটিসের কারনসমূহ
টাইপ ১ ডায়াবেটিসের আসল কারন অজানা। তবে, যতটুকু জানা গিয়েছে তা হলো ক্ষতিকর ব্যকটেরিয়া অথবা ভাইরাসের সাথে লড়াই করা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অগ্নাশয়ে ইনসুলিন উৎপন্নকারী কোষগুলোকে আক্রমন করে এবং ধ্বংস করে। এর ফলে আমাদের শরীরে ইনসুলিনের উৎপাদন কমে যায় অথবা সেটা একেবারেই হয় না। এর ফলে আমাদের কোষে না পৌঁছে শর্করা রক্তে জমা হয়।
তবে ধারনা করা হয় যে টাইপ ১ ডায়াবেটিস বংশগত এবং পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারনে হয়ে থাকে যদিও আসল কারন এখনো জানা যায়নি। টাইপ ১ ডায়াবেটিসে শারীরিক ওজনের কারনে হয়ে থাকে এমনটি মনে করা হয় না।
প্রি-ডায়াবেটিস এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের কারনসমূহ
টাইপ ২ ডায়াবেটিসে রূপ নিতে পারে প্রিডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আপনার কোষগুলো ইনসুলিন প্রতিরোধী হয়ে উঠে এবং আপনার অগ্নাশয় এই প্রতিরোধ সামাল দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমান ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না। এর ফলে, কোষের মধ্যে প্রবেশ না করে শর্করা আমাদের রক্তে জমা হয়।
তবে এমনটি কেনো হয় তা অজানা যদিও মনে করা হয় যে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার পেছনে বংশগত এবং পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারন ভূমিকা রাখতে পারে। শারীরিক স্থলতার সাথে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের সম্পৃক্ততা পাওয়া গিয়েছে তবে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সকলেই স্থল নন।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের কারনসমূহ
গর্ভাবস্থায় আমাদের প্লাসেন্টা গর্ভাবস্থা টিকিয়ে রাখতে হরমোন উৎপাদন করে। এই হরমোনগুলো আপনার কোষগুলোকে ইনসুলিন প্রতিরোধী করে তোলে।
সাধারণত আপনার অগ্নশয় অতিরিক্ত ইনসুলিন উৎপাদনের মাধ্যমে এই প্রতিরোধ কে সামাল দেয়। কিন্তু সবসময় আপনার অগ্নশয় এমনটি করতে পারে না। জেসটেশনাল ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে অনেক কম শর্করা আপনার কোষে প্রবেশ করে এবং বেশীরভাগ শর্করা রক্তে রয়ে যায়।