
প্রি-ডায়াবেটিস কী?
আপনার রক্তে চিনির পরিমান যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশী থাকে কিন্তু ডায়াবেটিসে আক্রাক্ত হওয়ার মত বেশী না হয় তবে এই অবস্থাকে বলা হয় প্রি-ডায়াবেটিস। চিকিৎসকরা এটিকে বলতে পারেন ইমপেয়ারড ফাস্টিং গ্লুকোজ অথবা ইমপেয়ারড গ্লুকোজ টলারেন্স।
যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের বেশীরভাগেরই প্রথমে প্রি-ডায়াবেটিস হয়েছে। কিন্তু এটির তেমন কোন উপসর্গ নেই। যুক্তরাষ্ট্রে বিশ বছরের অধিক বয়সী প্রায় ৮৪ মিলিয়ন মানুষের প্রি-ডায়াবেটিস রয়েছে কিন্তু এদের মধ্যে ৯০% তাদের এ অবস্থা সম্পর্কে অবগত নন।
প্রি-ডায়াবেটিসের চিকিৎসা টাইপ-২ ডায়াবেটিস সহ অনেক জটিল অসুখ রুখে দিতে পারে। এছাড়া আপনার হৃদযন্ত্র, রক্তনালী, চোখ এবং কিডনীর সম্ভাব্য সমস্যা থেকেও আপনি মুক্তি পেতে পারেন।
প্রি–ডায়াবেটিসের উপসর্গগুলো কী
আপনার যদি উপসর্গ থেকে থাকে, আপনি হয়তো লক্ষ্য করবেনঃ
- আপনার অনেক বেশী পিপাসা পায়।
- আপনি অনেক বেশী মুত্র ত্যাগ করেন।
- আপনি চোখে ঝাপসা দেখেন।
- অন্য সময়ের চেয়ে আপনি অনেক ক্লান্ত থাকেন।
প্রি–ডায়াবেটিসের কারন এবং ঝুঁকিগুলো কী কীঃ
আপনার প্রি-ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশী যদি আপনিঃ
- বয়স্ক হয়ে থাকেন বিশেষ করে ৪৫ বছরের অধিক বয়সী।
- আপনার কোমড় যদি ৪০ ইঞ্চির বেশী হয়ে থাকে (পুরুষদের ক্ষেত্রে) এবং ৩৫ ইঞ্চির অধিক (নারীদের ক্ষেত্রে)।
- আপনি প্রচুর রেডমিট এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস খেয়ে থাকেন ও চিনিযুক্ত পানীয় পান করেন এবং খুব বেশী ফল, সবজি, বাদাম, শস্যজাত খাবার অথবা অলিভ অয়েল না খেয়ে থাকেন।
- যদি আপনি আফ্রিকান আমেরিকান, আমেরিকান, ল্যটিনো অথবা প্যসিফিক আইল্যন্ডার হয়ে থাকেন।
- আপনি যদি স্থল হয়ে থাকেন বিশেষ করে আপনার পেটে যদি অধিক চর্বি থেকে থাকে।
- আপনার যদি অধিক মাত্রায় কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড, এলডিএল কোলেস্টেরল থেকে থাকে এবং এইচডিএল কোলেস্টেরল কম থেকে থাকে।
- আপনি যদি ব্যায়াম না করেন।
- আপনি যদি গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হউন অথবা ৯ পাউন্ডের অধিক ওজনের শিশুর জন্ম দিয়ে থাকেন।
- যদি আপনার পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম থেকে থাকে।
- আপনার যদি স্লিপ এপনিয়ার মত ঘুমের সমস্যা থেকে থাকে অথবা কাজে শিফট পরিবর্তন করতে হয়।
যদি উপরোক্ত লক্ষনসমূহ আপনার জন্য প্রযোজ্য হয় এবং আপনার নিম্ন বর্ণিত কোন সমস্যা থেকে থাকে তবে প্রি-ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করানঃ
- আপনার রক্তে চিনির মাত্রা অস্বাভাবিক হয়ে থাকে
- আপনার হৃদরোগ থেকে থাকে
- আপনার মধ্যে ইনসুলিন প্রতিরোধের লক্ষন দেখা যায় যার অর্থ হলো আপনার শরীর ইনসুলিন উৎপন্ন করে কিন্তু যেভাবে সাড়া দেয়া উচিত সেভাবে দেয় না। এর মধ্যে রয়েছেঃ ত্বকের কোন কোন স্থান কালচে হয়ে যাওয়া, মনোযোগ দিতে না পারা, এবং বেশী ক্ষুধা পাওয়া ও ক্লান্ত বোধ করা।
প্রি-ডায়াবেটিস নির্ণয়ে পরীক্ষা
আপনার চিকিৎসক অন্তত একটি পরীক্ষা করতে বলবেনঃ
ফাস্টিং প্লাজমা গ্লুকোজ টেস্টঃ আপনার ৮ ঘণ্টা পেট খালি রাখতে হবে এবং এরপর আপনার রক্ত নেয়া হবে চিনির মাত্রা পরীক্ষা করতে। ফলাফল হতে পারে নিম্নরূপঃ
- আপনার রক্তে চিনির পরিমান প্রতি ডেসিলিটারে ১০০ মিলি গ্রামের কম হলে এই মাত্রা স্বাভাবিক।
- রক্তে চিনির পরিমান ১০০ থেকে ১২৫ মিলিগ্রাম/ডিএল হলে আপনার প্রি-ডায়াবেটিস রয়েছে।
- আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত যদি চিনির পরিমান ১২৬ মিলিগ্রাম/ডিএল অথবা অধিক হয়ে থাকে।
ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট- প্রথমে আপনার ফাস্টিং প্লাজমা গ্লুকোজ টেস্ট করা হবে। এরপর, আপনাকে চিনিযুক্ত পানীয় পান করানো হবে। এর দু ঘণ্টা পর আপনার রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করা হবে। এই পরীক্ষার ফলাফল হতে পারে নিম্নরূপঃ
- আপনার রক্তে চিনির পরিমান যদি দ্বিতীয় পরীক্ষার পর ১৪০ মিগ্রা/ডিএল এর কম হয় তবে এটি স্বাভাবিক মাত্রা।
- আপনার রক্তে চিনির পরিমান যদি দ্বিতীয় পরীক্ষার পর ১৪০ থেকে ১৯৯ মিগ্রা/ডিএল এর মধ্যে হয় তবে আপনি প্রি-ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
- আপনার রক্তে চিনির পরিমান যদি দ্বিতীয় পরীক্ষার পর ২০০ মিগ্রা/ডিএল অথবা অধিক হয় তবে আপনি ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
হেমোগ্লোবিন এ১সি টেস্ট। এই পরীক্ষাটি বিগত ২ থেকে ৩ মাসে আপনার রক্তে চিনির গড় পরিমান দেখাবে। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের রক্তে চিনির পরিমান নিয়ন্ত্রনে রয়েছে কিনা তা দেখতে চিকিৎসকেরা এই পরীক্ষা করিয়ে থাকেন। এছাড়া প্রি-ডায়াবেটিস অথবা ডায়াবেটিস’র চিকিৎসাতেও এই পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষার ফলাফল হতে পারে নিন্মরূপঃ
- যদি ৫.৬% অথবা কম হয় তবে এটি স্বাভাবিক
- যদি ৫.৭% হতে ৬.৪% এর মধ্যে হয় তবে আপনি প্রি-ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
- যদি ৬.৫% অথবা এর চেয়ে অধিক হয় তবে আপনি ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
ফলাফলের বিষয়ে নিশ্চিত হতে আপনাকে আবার পরীক্ষাটি করাতে হতে পারে।
শিশুরা এবং প্রি-ডায়াবেটিসের পরীক্ষা
ব্যাক্তির বয়স যা হউক না কেনো চিকিৎসকেরা প্রি-ডায়াবেটিস রক্তে একই চিনির মাত্রার উপর ভিত্তি করে প্রি-ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে থাকেন। আমেরিকান ডায়াবেটিস এসোসিয়েশন’র তথ্যমতে ১০ বছর এবং তদুরধ বয়সী শিশুরা যদি স্থুল হয়ে থাকে এবং নিম্নের কোনটি তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, তবে তাদের রক্ত পরীক্ষা করা উচিতঃ
- তাদের পরিবারের কোন সদস্যের যদি টাইপ ২ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে।
- তার মায়ের যদি সে গর্ভে থাকাকালীন ডায়াবেটিস থেকে থাকে।
- সে যদি আমেরিকান, আফ্রিকান আমেরিকান, হিস্পানিক, এশিয়ান আমেরিকান, অথবা প্যসিফিক আইল্যন্ডার হয়ে থাকেন।
- যদি তার শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধের লক্ষন থাকে অথবা এর সাথে সম্পৃক্ত কোন রোগ থেকে থাকে যেমনঃ জম্নের সময় কম ওজন থাকা, উচ্চ রক্তচাপ অথবা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম।
যদি প্রি-ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে থাকা কোন শিশুর পরীক্ষার ফল স্বাভাবিক হয় তবে আমেরিকান ডায়াবেটিস এসোসিয়েশন অন্তত প্রতি ৩ বছরে তাকে আবারো পরীক্ষার সুপারিশ করেছে।
প্রি-ডায়াবেটিসের জটিলতা
চিকিৎসা না করালে প্রি-ডায়াবেটিস টাইপ-২ ডায়াবেটিসে রূপ নিতে পারে অথবা অন্যান্য গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে যেমনঃ
- কিডনী রোগ
- অন্ধত্ব
- উচ্চ রক্তচাপ
- স্নায়ুর সমস্যা (পেরিফেরাল নিউরোপ্যথী)
- অঙ্গহানী (এমপিউটেসন)
প্রি-ডায়াবেটিস নিরাময়ের চিকিৎসা
প্রি-ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় নিম্নের পদক্ষেপগুলো গ্রহন করতে পারেনঃ
- স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহন করুন এবং ওজন কমান। আপনি যদি আপনার শরীরের ওজনের ৫% হতে ১০% কমাতে পারেন তবে তা বিশাল পার্থক্য গড়ে দিবে।
- ব্যায়াম। এমন কিছু করুন যেটি আপনি পছন্দ করেন। যেমনঃ হাঁটুন। এটি অন্তত দিনে ৩০ মিনিট এবং সপ্তাহে ৫ দিন করার চেষ্টা করুন। আপনি অল্প সময়ের জন্য আরম্ভ করতে পারেন এবং আধ ঘণ্টা পর্যন্ত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করতে পারেন। এর চেয়ে অদিক সময় করতে চাইলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- ধূমপান ত্যাগ করুন।
- আপনার রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রনে রাখুন।
- আপনার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকলে রক্তে চিনির পরিমান কম রাখতে মেটফরমিন (গ্লুকোফেজ) জাতীয় ঔষধ সেবন করুন।
প্রি-ডায়াবেটিসের জন্য কোন বিশেষ খাবার আছে কী?
প্রি-ডায়াবেটিসের জন্য কোন বিশেষ খাবার নেই তবে চারটি অভ্যাস প্রি-ডায়াবেটিস নিরাময় করতে পারে এবং আপনার টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারেঃ
- প্রক্রিয়াজাত কার্বোহাইড্রেট যেমনঃ সাদা রুটি, আলু এবং সেরেয়ালের স্থলে শস্য এবং শস্য থেকে তৈরি খাবার বেছে নিন।
- চিনিযুক্ত পানীয়ের পরিবর্তে কফি, পানি এবং চা পান করুন।
- মারজারিন, বেকড খাবার এবং ভাজাপোড়া খাবারে থাকা তেলের চেয়ে ভেজিটেবল অয়েল, বাদাম এবং বীজে থাকে এমন উপকারী তেল বেছে নিন।
- রেড মিট এবং প্রক্রিয়াজাত মাংসের পরিবর্তে বাদাম, শস্যদানা, পোল্ট্রি এবং মাছ খাওয়ার অভ্যাস করুন।
কিভাবে প্রি-ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা যায়
নিয়মিত ব্যায়াম করলে এবং কার্বোহাইড্রেট, চিনি, ননী এবং লবন কম থাকে এমন খাবার খেলে প্রি-ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। এছাড়াওঃ
- ধূমপান করবেন না।
- দিনে একবারের অধিক মদপান করবেন না।
- চিকিৎসকের পরামর্শমত নিয়মিত ঔষধ সেবন করুন।