
লিন এলড্রিজ
ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এবং সুস্থ কোষের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। কিছু পার্থক্য আমাদের সকলের জানা আছে অপরদিকে অন্যান্য পার্থক্যগুলো সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এখনো ভালোভাবে জানা যায়নি। আপনি যদি নিজের অথবা প্রিয়জনের ক্যান্সারের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে চান তবে আপনি হয়তো জানতে আগ্রহী হবেন কিভাবে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলো আলাদা।
গবেষকদের জন্য এটি জানা জরুরী কিভাবে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ সুস্থ কোষের চেয়ে ভিন্নভাবে কাজ করে থাকে কেনোনা এর ফলে সুস্থ কোষগুলোর ক্ষতি না করে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ শরীর থেকে সরিয়ে ফেলার চিকিৎসার ভিত্তি রচিত হতে পারে।
এই প্রতিবেদনের প্রথম ভাগে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এবং সুস্থ কোষের মধ্যকার মূল তফাৎগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনের দ্বিতীয় ভাগটি একটু বেশী জটিল এবং সাহায্যে করবে তাঁদের যারা ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এবং সুস্থ কোষের মধ্যেকার আরো ব্যাপক জটিল পার্থক্যগুলো সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।
কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন
ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ সম্পর্কে বুঝতে হলে শরীরের কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করে এমন প্রোটিনগুলো সম্পর্কে ব্যাখ্যা সাহায্য করবে। আমাদের ডিএনএতে রয়েছে জিন যেগুলো আমাদের শরীরে উৎপাদিত প্রোটিনগুলোর প্রতিচিত্র।
এগুলোর মধ্যে কোন কোন প্রোটিন কোষের বৃদ্ধির জন্য দায়ী। এসব প্রোটিনের মধ্যেকার কেমিক্যাল কোষগুলোকে ভাগ হতে এবং বৃদ্ধি হতে সংকেত দিয়ে থাকে। আবার অন্যান্য প্রোটিন কোষের বৃদ্ধি কমাতে কাজ করে।
নির্দিষ্ট জিনে মিউটেশনের ফলে (ধূমপান, বিকিরন, অতি বেগুনি রশ্নির বিকিরন এবং অন্যান্য ক্যান্সারের কারন পদার্থের কারনে) প্রোটিনের অস্বাভাবিক উৎপাদন হয়ে থাকে। এর ফলে অতিরিক্ত পরিমাণে প্রোটিন উৎপাদিত হতে পারে এবং এই প্রোটিনগুলো অস্বাভাবিক হতে পারে এবং ভিন্নভাবে কাজ করতে পারে।
ক্যান্সার একটি জটিল রোগ এবং মিউটেশন অথবা প্রোটিনের অস্বাভাবিকতা ছাড়াও অন্যান্য অস্বাভাবিকতার কারনে একটি কোষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে।
ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ বনাম সুস্থ কোষ
সুস্থ কোষ এবং ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের মধ্যে কিছু বড় ধরনের পার্থক্য নিম্নে আলোচনা করা হলো। এর মাধ্যমে বোঝা যাবে কিভাবে ম্যালিগনেন্ট টিউমার বৃদ্ধি পায় এবং বিনাইন টিউমারের চেয়ে ভিন্ন আচরন করে থাকে।
বৃদ্ধি
পর্যাপ্ত পরিমান কোষের উপস্থিতিতে সুস্থ কোষ বংশ বৃদ্ধি বন্ধ করে দেয়। উদাহরন হিসেবে বলা যায় যদি ত্বকের কোন কাটা মেরামত করতে কোষ বংশ বৃদ্ধি করে সে ক্ষেত্রে ক্ষত স্থান ঢেকে দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমান কোষের বৃদ্ধি ঘটলে নতুন কোন কোষ আর উৎপাদিত হয় না।
অন্যদিকে, পর্যাপ্ত পরিমান কোষ উপস্থিত থাকলেও ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ বংশ বৃদ্ধি বন্ধ করে না। অনিয়ন্ত্রিত কোষের বৃদ্ধির কারনে টিউমারের (ক্যান্সার কোষের গুচ্ছ) সৃষ্টি হয়।
আমাদের শরীরে প্রতিটি জিনে বিভিন্ন প্রোটিনের কোড হিসেবে প্রতিচিত্র রয়েছে। এগুলোর কোন কোন প্রোটিন কোষের বংশ বৃদ্ধির সাথে জড়িত এবং এগুলোর ক্যামিকেল কোষকে ভাগ হতে এবং বংশ বৃদ্ধিতে সংকেত প্রদান করে। যদি এ সকল প্রোটিনের জন্য কোড বহনকারী কোন জিন কোন অবস্থানে মিউটেশনের (অনকোজিন) জন্য আটকে পড়ে সে ক্ষেত্রে কোষের বংশ বৃদ্ধির জন্য দায়ী প্রোটিনের উৎপাদন অব্যাহত থাকে। এবং এ কারনে কোষের বংশ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে।
যোগাযোগ
সুস্থ কোষের মত ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ অন্যদের সাথে যোগাযোগ করে না। সুস্থ কোষগুলো তাঁদের কাছাকাছি কোষ থেকে প্রাপ্ত সংকেতের সাড়া দিয়ে থাকে। সংকেতটি হতে পারে এরকম “তুমি তোমার শেষ সীমারেখায় পৌঁছে গেছো”। এই সংকেতটি পাবার পর সুস্থ কোষ বংশ বৃদ্ধি বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এ জাতীয় সংকেতের সাড়া দেয় না।
কোষের মেরামত এবং মৃত্যু
সুস্থ কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে অথবা বুড়িয়ে গেলে মেরামতের প্রয়োজন হয় অথবা কোষগুলো মৃত্যুবরন করে (যাকে বলে এপটোসিস)। ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের এপটোসিস হয়না অথবা মেরামত হয় না।
উদাহরন হিসেবে বলা যায় পি৫৩ নামক একটি প্রোটিনের কাজ হলো দেখা কোন কোষ খুব বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা এবং মেরামতের প্রয়োজন আছে কিনা। সেক্ষেত্রে, এই প্রোটিনটি কোষটিকে উপদেশ দেয় যেনো এটি নিজে নিজেকে মেরে ফেলে। যদি পি৫৩ নামক প্রোটিনটি অস্বাভাবিক হয় অথবা অকার্যকর থাকে (পি৫৩ নামক জিনে মিউটেশনের কারনে) সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা বুড়িয়ে যাওয়া কোষটি বংশবৃদ্ধি করতে থাকে।
এই পি৫৩ জিন টিউমার তৈরি হওয়াকে নিরুৎসাহিত করে থাকে এবং এটি হচ্ছে কোষের বংশ কমানোর জন্য দায়ী প্রোটিনের কোড।
আঠালো ভাব
সুস্থ কোষ এক ধরনের জিনিস নির্গত করে থাকে যেটির মাধ্যমে কোষগুলো দলবদ্ধ হয়ে একসাথে আটকে থাকে। ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এই জিনিসটি নির্গত করতে পারে না যে কারনে কাছাকাছি গন্তব্যে অথবা শরীরের দূরবর্তী গন্তব্যে রক্তের মাধ্যমে অথবা লিম্ফ চ্যানেলের মাধ্যমে “ভেসে যেতে” পারে।
ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতা
সুস্থ কোষ শরীরের যে স্থানে থাকার কথা সেখানে অবস্থান করে। উদাহরন হিসেবে বলা যায় ফুসফুসের কোষ ফুসফুসে অবস্থান করে। কোন কোন ক্যান্সার আক্রান্ত কোষে আঠালো জিনিসটি থাকে না যে কারনে এগুলো আটকে না থেকে রক্তের মাধ্যমে অথবা লিম্ফেটিক সিস্টেমের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়ায়। ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলোর ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতা থাকে।
যখন এই কোষগুলো নতুন কোন স্থানে আসে (যেমনঃ লিম্ফ নোডে, ফুসফুসে, যকৃতে অথবা হাড়ে) এগুলো বংশ বৃদ্ধি করে এবং টিউমারের সৃষ্টি হয় যা কিনা মূল টিউমার থেকে বেশ কিছু দুরেও হতে পারে।
আকার
অণুবীক্ষণ যন্ত্রে সুস্থ কোষ এবং ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ ভিন্ন দেখাতে পারে। সুস্থ কোষের তুলনায় ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের আকার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এগুলোর কোনটি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় এবং ছোট হয়ে থাকে।
সেই সাথে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এবং এটির নিউক্লিয়াস অস্বাভাবিক আকারের হয়ে থাকে। কোষের নিউক্লিয়াস স্বাভাবিক কোষের নিউক্লিয়াসের চেয়ে বড় এবং অন্ধকার দেখায়।
ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের নিউক্লিয়াসে অতিরিক্ত ডিএনএ থাকায় এটিকে অন্ধকার দেখায়। কাছাকাছি থেকে দেখলে দেখা যায় ক্যান্সার আক্রান্ত কোষে অস্বাভাবিক সংখ্যায় ক্রোমোজম থাকে এলোমেলো অবস্থায়।
বৃদ্ধির হার
সুস্থ কোষ নিজ থেকেই বৃদ্ধি পায় এবং পর্যাপ্ত পরিমান কোষ তৈরি হলে বৃদ্ধির প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। কোষ পরিপক্ক হবার পূর্বেই ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ দ্রুততার সাথে বৃদ্ধি পায়।
পরিপক্কতা
সুস্থ কোষ পরিপূর্ণতা লাভ করে। ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ পরিপূর্ণতা অর্জনের পূর্বেই দ্রুততার সাথে বংশ বৃদ্ধি করে। চিকিৎসকেরা অপরিপক্ক কোষ কে “আলাদা করা যায় না” বলে বর্ণনা করেন।
আরেকভাবে বলা যায় যে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ বড় হয় না এবং পরিপক্ক কোষে পরিণত হয় না। কোষগুলো কতটুকু পরিপক্ক হচ্ছে সেটি দেখে ক্যান্সারের গ্রেড বোঝা যায়। ক্যান্সার কে ১ থেকে ৩ এর মধ্যে গ্রেডিং করা হয় যেখানে ৩ হচ্ছে সবচেয়ে আগ্রাসী অবস্থা।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়া
সুস্থ কোন কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (লিম্ফোসাইট নামক কোষের মাধ্যমে) সেটিকে শনাক্ত করে এবং সরিয়ে ফেলে।
ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ দীর্ঘ সময় আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে থাকতে পারে অথবা ক্যামিকেল নির্গমনের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধী কোষগুলোকে অকার্যকর করে দেয়। এ কারনে কোষগুলো টিউমারে পরিণত হয়। কিছু কিছু নতুন উদ্ভাতিত ইমিউনোথেরাপি সংক্রান্ত ঔষধ ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের এই বৈশিষ্টকে সামাল দিয়ে থাকে।
কার্যকারিতা
সুস্থ কোষ তার জন্য নির্ধারিত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। অপরদিকে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এমনটি করতে পারে না।
যেমনঃ সুস্থ শ্বেত কণিকা প্রদাহ দমনে কাজ করে থাকে। লিউকোমিয়া হলে শ্বেত কণিকার সংখ্যা প্রচুর হলেও কার্যকরভাবে কাজ করতে না পারায় মানুষ অনেক বেশী শ্বেত কণিকা থাকা সত্ত্বেও সংক্রমিত হতে পারে।
একই অবস্থা হতে পারে উৎপাদিত বিভিন্ন জিনিসের ক্ষেত্রে। যেমনঃ সুস্থ থাইরয়েডের কোষ থাইরয়েড হরমোন উৎপন্ন করে। অপরদিকে ক্যান্সার আক্রান্ত থাইরয়েডের কোষ এই হরমোন নাও উৎপন্ন পারে। এ ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণে থাইরয়েড কোষ থাকার পরও শরীরে থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হতে পারে (যা হাইপোথাইরোইডিজম নামে পরিচিত)।
রক্ত সঞ্চালন
যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোষগুলো বৃদ্ধির জন্য এবং টিস্যুর পুষ্টির জন্য রক্তনালীকে আকৃষ্ট করে তাকে বলা হয় এনজিওজেনেসিস। সুস্থ কোষগুলোতে এনজিওজেনেসিস হয়ে থাকে সাধারন বৃদ্ধির অংশ হিসেবে এবং যখন ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু মেরামতের জন্য নতুন টিস্যুর প্রয়োজন হয়।
ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলোতে অকারনেই এনজিওজেনেসিস হয়ে থাকে। এক ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসায় এনজিওজেনেসিস কমানোর ঔষধ ব্যবহার করা হয় এবং এর মাধ্যমে টিউমারের বৃদ্ধি রোধের চেষ্টা করা হয়।
আরো কিছু তফাৎ
নিম্ন বর্ণিত তালিকায় সুস্থ কোষ এবং ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের মধ্যে আরো কিছু পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যারা এসব জটিল বিষয় এড়িয়ে চলতে চান, তাঁরা তফাৎগুলোর সংক্ষিপ্তসার দেখে নিতে পারেন।
বৃদ্ধি দমনকারীদের এড়িয়ে চলা
সুস্থ কোষগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় টিউমারের মাধ্যমে। তিন ধরনের টিউমার সাপ্রেসর জিন রয়েছে যেগুলো বৃদ্ধি কমায় এমন প্রোটিনসমূহের কোড।
এক ধরনের প্রোটিন কোষের বৃদ্ধি কমিয়ে দেয় এবং বিভাজন বন্ধ করে। আরেক ধরনের প্রোটিন ক্ষতিগ্রস্ত কোষে পরিবর্তনগুলো নির্ধারণ করে। তৃতীয় ধরনের প্রোটিন এপোপ্টোসিসের কাজ করে। মিউটেশনের কারনে এ সকল টিউমার সাপ্রেসর জিন অকার্যকর হলে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ নিয়ন্ত্রনহীনভাবে বৃদ্ধি পায়।
আক্রমণাত্মকতা
সুস্থ কোষ চারপাশের কোষ হতে প্রাপ্ত সংকেতে সাড়া দেয় এবং কাছাকাছি অবস্থিত টিস্যুকে দখলে নিলে বৃদ্ধি বন্ধ করে দেয়। ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এসকল কোষকে হেলা করে এবং আশেপাশের টিস্যুকে আক্রমন করে।
বিনাইন টিউমারের রয়েছে একটি আঁশযুক্ত ক্যাপসুল। এগুলো আশে পাশের টিস্যুগুলোকে চাপ প্রয়োগ করলেও অন্য টিস্যুগুলোকে আক্রমন করে না।
তুলনামূলকভাবে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ কোন সীমারেখা মেনে চলে না এবং টিস্যু দখল করে। এর ফলে ক্যান্সার আক্রান্ত টিউমারের রেডিওলজিক স্ক্যানে আঙ্গুলের মত প্রক্ষিপ্ত ছবি দেখা যায়। ক্যান্সার শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ক্র্যাব থেকে যেটি ব্যবহার করা হয় টিস্যু সমূহের উপর ক্যান্সারের কাঁকড়ার মত আক্রমনকে বোঝাতে।
শক্তির উৎস
সুস্থ কোষ ক্রেবস সাইকেল (এটিপির মাধ্যমে) নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বেশীর ভাগ শক্তি অর্জন করে এবং বাদ বাকি শক্তি গ্লাইকোলাইসিস নামক একটি ভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করে।
বেশীর ভাগ ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ অক্সিজেনের উপস্থিতি সত্ত্বেও গ্লাইকোলাইসিসের মাধ্যমে শক্তি অর্জন করে। সুতরাং হাইপারবারিক অক্সিজেন থেরাপীর পেছনের যুক্তি সঠিক নয়। কখনো কখনো হাইপারবারিক অক্সিজেন ক্যান্সারের বৃদ্ধি কে উৎসাহিত করে।
মরনশীলতা/অমরত্ত
মরনশীল হওয়ায় সুস্থ কোষগুলোর রয়েছে একটি জীবনকাল। কোষগুলো কখনোই চিরদিন বাঁচে না এবং মানুষের মতই কোষ বুড়িয়ে যায়। গবেষকরা বর্তমানে টেলোমিরাস নামক একটি কাঠামোর দিকে নজর দিচ্ছেন যেটি ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ক্রমোজোমের শেষভাগে ডিএনএকে একসাথে ধরে রাখে।
সুস্থ কোষের বেড়ে ওঠার অন্যতম সীমাবদ্ধতা হচ্ছে টেলোমিরাসের দৈর্ঘ্য। প্রতিবার কোষ বিভাজনের সময় টেলোমিরাস ছোট হয়ে যায়। টেলোমিরাস যখন খুব বেশী ছোট হয়ে যায় তখন একটি কোষ আর বিভাজন হতে পারে না এবং এটি মরে যায়।
তবে, ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ টেলোমিরাস পূর্ণজীবিত করতে পারে এর ফলে ওই কোষ ভাগ হতে থাকে। টেলোমিরেস নামক একটি এনজাইম টেলোমিরাস কে লম্বা করে যাতে করে কোষটি অনির্দিষ্টকালের জন্য ভাগ হতে পারে এবং এক কথায় অমরত্ব অর্জন করে।
লুকিয়ে থাকার সক্ষমতা
অনেকে ভেবে থাকেন কেনো ক্যান্সার অনেক বছর পর ফিরে আসে এবং কখনো কখনো এটি চলে গেছে এমনটি ভাবার দশ বছর পরও ফেরত আসে (বিশেষ করে টিউমারের ক্ষেত্রে যেমনঃ এসট্রোজেন রিসেপ্টর ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে)। ক্যান্সার কেনো ফিরে আসে এ নিয়ে রয়েছে বেশ কিছু তত্ত্ব।
সাধারণত মনে করা হয় ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের রয়েছে একটি শ্রেণীবিন্যাস যেখানে কিছু কোষ (ক্যান্সার স্টেম সেল) চিকিৎসা প্রতিহত করতে পারে এবং সুপ্ত থাকতে পারে। এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এ নিয়ে গবেষণা চলমান রয়েছে।
জিনোমের অস্থিতিশীলতা
সুস্থ কোষের থাকে সুস্থ ডিএনএ এবং ক্রোমজোমের সংখ্যাও থাকে স্বাভাবিক। ক্যান্সার আক্রান্ত কোষে ক্রোমজোমের সংখ্যা থাকে অস্বাভাবিক এবং ডিএনএ একাধিক মিউটেশনের ফলে অস্বাভাবিক হয়ে যায়।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে ড্রাইভার মিউটেশন যার মাধ্যমে একটি কোষ জোরপূর্বক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। বেশ কিছু মিউটেশন প্যসেঞ্জার মিউটেশনের মাধ্যমে হয়ে থাকে যার অর্থ ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের জন্য আর কিছু করণীয় থাকে না।
কিছু কিছু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কোন জাতীয় ড্রাইভার মিউটেশন সক্রিয় রয়েছে সেটি নির্ধারণ করতে চিকিৎসকেরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু ঔষধ ব্যবহার করেন যেগুলো ক্যান্সারকে নির্দিষ্ট করে কাজ করে।
ক্যান্সার চিকিৎসায় দ্রুত বর্ধনশীল নির্দিষ্ট চিকিৎসার মধ্যে ইজিএফআর ইনহিবিটর থেরাপী দেয়া হয় ইজিএফআর মিউটেশনকে উদ্দেশ্য করে।
কিভাবে একটি কোষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়
উপরে যেমনটি বলা হয়েছে যে সুস্থ কোষ এবং ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষের মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে। বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে হলে একটি কোষকে এড়িয়ে যেতে হবেঃ
- কোষটি বৃদ্ধি পাবে এমনকি যখন এটির বৃদ্ধির কোন প্রয়োজন নেই।
- কোষগুলো সেসব প্রোটিনকে এড়িয়ে চলবে যেগুলো অস্বাভাবিকতার ক্ষেত্রে কোষের বৃদ্ধি রোধ করে এবং মৃত্যু ঘটায়।
- কোষটি অন্যান্য কোষ থেকে প্রাপ্ত সংকেত এড়িয়ে চলবে।
- কোষগুলো আঠালো ভাব হারাবে যা কিনা কোষের বৃদ্ধি ঘটায়।
সব মিলিয়ে একটি সুস্থ কোষের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া বেশ কঠিন। তবে, এটি আশ্চর্যের বিষয় যে প্রতি তিন জনে একজন তাঁদের জীবনে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।
ব্যাখা হিসেবে বলা যায় সাধারনত আমাদের শরীরে প্রতিদিন প্রায় তিন কোটি কোষ ভাগ হয়ে থাকে। কোষের বিভাজনের সময় বংশগত কারনে অথবা ক্যান্সারের কারন হতে পারে এমন জিনিসের দ্বারা “দুর্ঘটনা” ঘটলে এক ধরনের কোষের উদ্ভব হতে পারে যা একাধিক মিউটেশনের পর ক্যান্সার আক্রান্ত কোষে পরিণত হয়।
যেমনটি বলা হয়েছে যে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এবং সুস্থ কোষের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক তফাৎ এবং এই কোষগুলো যথাক্রমে ম্যলিগনেন্ট এবং বিনাইন টিউমারে রূপ নেয়। সেই সাথে ক্যান্সার কোষ এবং সাধারন কোষধারি টিউমারগুলো শরীরে ভিন্ন আচরন করে থাকে।
ক্যান্সার স্টেম সেল সম্পর্কে ধারনা
ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এবং সুস্থ কোষের মধ্যকার এতোসব পার্থক্য নিয়ে আলোচনার পর আপনি ভাবতে পারেন ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলোর মধ্যে কোন তফাৎ আছে কিনা! ক্যান্সার আক্রান্ত কোষেরও থাকতে পারে শ্রেণীবিন্যাস এবং এগুলো একে অপরের চেয়ে ভিন্ন ধরনের কাজ করতে পারে যেটি ক্যান্সার স্টেম সেল সম্পর্কে আলোচনার মূল ভিত্তি।
আমরা এখনও বুঝতে পারিনা কিভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষ বছরের পর বছর এমনকি দশকের পর দশক লুকিয়ে থাকতে পারে এবং এক সময় আবির্ভূত হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের শ্রেণীবিন্যাসে “জেনারেল” রা যাদের বলা হচ্ছে ক্যান্সার স্টেম সেল সম্ভবত চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক বেশী প্রতিরোধী এবং এগুলো সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে যখন অন্যান্য সৈনিক শ্রেণীর ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলো কেমোথেরাপীর মত চিকিৎসার মাধ্যমে অপসারিত হয়।
বর্তমানে আমরা টিউমারের মধ্যকার ক্যান্সার কোষগুলোকে আলাদা ভাবে চিকিৎসা করি। হয়তোবা ভবিষ্যতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি টিউমারের অভ্যন্তরে ক্যান্সার কোষগুলোর মধ্যকার তফাৎগুলোকে বিবেচনা করা হবে।
ভেরিওয়েলের পক্ষ থেকে কিছু কথা
অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন এই ভেবে যে আমরা কেনো এখনও সব ধরনের ক্যান্সারকে আটকাতে পারছি না। এর পেছনের জটিলতাগুলোর কিছু কিছু আমরা বুঝতে পারবো যদি আমরা বুঝতে পারি একটি কোষে ক্যান্সার হলে কত ধরনের পরিবর্তন ঘটে থাকে। একটি নয় বরং অনেকগুলো বিষয় বর্তমানে বিভিন্নভাবে গবেষণা করা হচ্ছে।
সেই সাথে ক্যান্সার একটি মাত্র রোগ নয় বরং অনেক রোগের সমষ্টি। এমনকি দুই ধরনের ক্যান্সার যেগুলোর ধরন এবং পর্যায় এক সেগুলো ভিন্নভাবে আচরন করতে পারে। একটি কক্ষে যদি একই ধরনের এবং একই পর্যায়ের ক্যান্সার আক্রান্ত ২০০ ব্যাক্তি থেকে থাকেন তবে মলেকিউলার প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে তাঁদের ২০০ ভিন্ন ধরনের ক্যান্সার থাকতে পারে।
তবে আমরা যদি জানতে পারি একটি কোষ কেনো ক্যান্সার আক্রান্ত কোষে পরিণত হয় তাহলে আমরা জানতে পারবো কিভাবে কোষটি প্রজনন বন্ধ করা যেতে পারে এবং প্রথমেই কিভাবে একটি কোষকে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পরিনতি হতে রক্ষা করা যেতে পারে।
ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এবং স্বাভাবিক কোষকে আলাদা করতে পারে এমন বিভিন্ন থেরাপী উদ্ভাবনের মাধ্যমে এক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
ইমিউনোথেরাপীর উপর গবেষণা আসলেই বেশ চাঞ্চল্যকর কেনোনা ক্যান্সার আক্রান্ত কোষকে খুঁজে বের করে ধ্বংস করার জন্য আমরা নিজেরাই নিজেদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে “উত্তেজিত” করার উপায় বের করতে পারছি যেটি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কাছে অজানা নয়।
কিভাবে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলো “ছদ্মবেশ” ধারন করে লুকিয়ে থাকে সেটি বোঝার মাধ্যমে উন্নত চিকিৎসা যেমন উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে চূড়ান্ত পর্যায়ে টিউমারে আক্রান্ত কারো কারো সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ সম্ভব হয়েছে।