
হেলথ হাইপ ডেস্কঃ
ধরুন, আপনি গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। গভীর রাতে আপনার কোন প্রিয়জনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিলো। তাৎক্ষনিক ডাক্তারের পরামর্শ প্রয়োজন। স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র অনেক দূর। যানবাহন নেই। সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা বিপজ্জনক। কী করবেন, সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আপনার মনে পড়লো নির্দিষ্ট একটি নাম্বারের কথা। ফোন দিলেন। অপর প্রান্ত থেকে দরদ মাখা একটি কন্ঠ আপনাকে আশ্বস্ত করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলেন। অথবা ধরুণ, আপনার রোগীকে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র পর্যন্ত নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ। সেক্ষেত্রে পূর্বের করানো বিভিন্ন ধরণের টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে মোবাইল ফোন কিংবা ল্যাপটপের সামনে বসে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আপনার ডাক্তারকে দেখিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিলেন।
হ্যাঁ! এই বিষয়গুলো এখন আপনার হাতের নাগালে। টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করে যে কোন স্থান থেকে যে কোন সময়ে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া-নেওয়াকে দূরচিকিৎসা বা Telemedicine বলে। এটি স্বাস্থ্যসেবার এক নতুন সংস্করণ।
উচ্চ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগে এ ধরণের সেবা কাংখিত ও স্বাভাবিক মনে হলেও শুরুটা হয়েছিলো রেডিওগ্রাফিক ইমেজ ট্রান্সফারের মধ্য দিয়ে ১৯০৫ সালের দিকে। ঐ সময়ে ওলন্দাজ চিকিৎসক উইলেম আইন্দোভেন বিভিন্ন রিমোট অঞ্চলে বসবাসরত হৃদরোগীদের পাঠানো ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি) রিপোর্ট দেখে ব্যবস্থাপত্র দিতেন। এরপর ১৯২০’র দশক থেকে শুরু হয়ে ১৯৪০’র দশক পর্যন্ত রেডিও সিগন্যাল ব্যবহার করে দূরবর্তি সামূদ্রিক জাহাজ ও দ্বীপসমূহে অবস্থানরত নাবিকদের স্বাস্থ্যসেবা/পরামর্শ দেয়ার কার্যক্রম চলে। নরওয়ে, ইতালি এবং ফ্রাসের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে এসব কর্মসূচী চালানো হয়।
তবে সমন্বিত ও সংগঠিত টেলিমেডিসিন সেবা কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫০’র দশকে আমেরিকাতে। প্রায় দশক দুই চলার পর নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে স্থগিত হয়ে যায় এই সেবা। বর্তমানে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, নতুন নতুন সফটওয়্যার আবিষ্কার এই সেবাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় এনে দিয়েছে। দিন-রাত ২৪ ঘন্টার যে কোন সময় মানুষ এখন এ সেবা নিতে পারছে।
দূরচিকিৎসা সেবা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। কোনো সাধারণ রোগ বা প্রতিষেধক সম্পর্কে তাৎক্ষণিক ফোন করে জেনে নেওয়া যায়। আবার কিছু কিছু রোগ বা লক্ষণ আছে, যা না দেখে প্রতিষেধক বা করণীয় ঠিক করা যাবে না—এমনটি হলে ভিডিও-সম্মেলনের মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগীর সমস্যা শোনা, পরীক্ষার রিপোর্ট দেখা, রোগ সনাক্তকরণ ও মূল্যায়ন, ড্যাটা সংরক্ষণ, প্রয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সিং – এসবই টেলিমেডিসিনের আওতায় পড়ে। এতে রোগীদের একদিকে যাতায়ত, থাকা-খাওয়ার খরচ যেমন কমে তেমনি সময়ও বাঁচে। শুধু ডাক্তারের প্রয়োজনীয় ফি প্রদান করে এ সেবা নেয়া যায়। তবে সরকারি এবং কিছু কিছু বেসরকারি পর্যায়ে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে টেলিমেডিসিন সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।
এখানে এ্যপয়েন্টমেন্ট নেয়াটা রেগ্যুলার এ্যপয়েন্টমেন্ট এর মতই। এরপর ক্যামেরার সামনে বসে অথবা মোবাইলে ডাক্তার আর রোগীর কথপকথণ চলে। একে আমরা ভার্চ্যুয়াল ভিজিট বলতে পারি। বাড়িতে কিংবা সুবিধাজনক স্থানে বসে যেকোন সময়ে এই সেবা আদান-প্রদান করা যায়। আমেরিকাতে এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় ৭৫% রোগী বাড়িতে বসে এই সেবা পেতে আগ্রহী।
বাংলাদেশে দূরচিকিৎসা
বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশে যেখানে প্রতি ১০০০০ জনে মাত্র ছয় জন ডাক্তার সেখানে একজন ডাক্তারের এ্যপয়েন্টমেন্ট পাওয়া (বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের) কতটা কঠিন তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। অধিকন্তু দেশের প্রায় ৬৪% মানুষ বাস করেন গ্রামে, রিমোট অঞ্চলে যেখানে হাসপাতাল কিংবা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নাই, থাকলেও খুবই অপ্রতুল। যেসব স্থানে আছে সেগুলোর বেশিরভাগ অচল। কঠিন যাত্রায় এবড়ো-থেবড়ো পথ অতিক্রম করার পর যদিও বা এ্যপয়েন্টমেন্ট মেলে দেখা যায় ডাক্তার হয়তো রোগীর চাপ সামলাতে গিয়ে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারেন না। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দূরচিকিৎসা বা Telemedicine।
বাংলাদেশে প্রথম এই সেবা শুরু করে Swinfen Charitable Trust of UK এর অর্থায়নে Center for Rehabilitation of Paralyzed (CRP) ১৯৯৯ সালে। এরপর বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই সেবা নিয়ে আসে যেমনঃ Telemedicine Reference Center Limited (TRCL), Sustainable Development Network Program (SDNP), BUET, Comfort Nursing Home, Mobile Maternal, Newborn, and Child Health (MNCH) BRAC ইত্যাদি। ইদানিং বেশ ক’টি মোবাইল অপারেটর কোম্পানিও Telemedicine সেবা দিয়ে আসছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৮টি হাসপাতালে উন্নত মানের দূরচিকিৎসা সেবা চালু আছে এবং দেশের ২২ টি ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রে দূরচিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগে বসে চিকিৎসকরা স্কাইপ ও অন্যান্য ভিডিও কনফারেন্সিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিনামূল্যে কর্মদিবসগুলোতে এ সেবা দিচ্ছেন। দু’টি বিশেষায়িত হাসপাতাল Bangabandhu Sheikh Mujib Medical University ও National Institute of Cardiovascular Diseases, তিনটি জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল (সাতক্ষিরা, গোপালগঞ্জ, নীলফামারি) এবং তিনটি উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল (পীরগঞ্জ, দাকোপ ও দেবহাটা)–তে উন্নত দূরচিকিৎসা সেবা প্রদান করছে।
এছাড়া ‘মোবাইল ফোন স্বাস্থ্যসেবা’র আওতায় দেশব্যাপী বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরামর্শ সেবা চালু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যেখানে কর্মরত ডাক্তারগণ ২৪ ঘন্টাই রোগীদের মোবাইল ফোনে স্বাস্থ্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ধনি-গরীব নির্বিশেষে এই সেবা পেতে পারেন। এতে সাধারণ রোগীরা যেমন উপকৃত হন তেমনি জটিল ও মরণাপন্ন রোগীদের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক ব্যবস্থা গ্রহণ সহজ হয়। দূরবর্তি হাসপাতাল কিংবা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র যেমন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক এ নেয়ার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে অপচিকিতসার হাত থেকেও বাঁচা যায়।
আরো আছে স্বাস্থ্য বাতায়ন সেবা। এখানে ১৬২৬৩ নম্বরে ডায়াল করে যেকোন প্রকার স্বাস্থ্য পরামর্শ পাওয়া যায়।
করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে সরকারি উদ্যোগে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য টেলিমেডিসিন সেবা, মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সেবা চালু হয়েছে। এ সংক্রান্ত সরকারি ওয়েবসাইটে যেসব সেবার কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে আছেঃ
১। প্রবাসীরা যে দেশে আছেন সে দেশের কোভিড-১৯ বিষয়ক জরুরী চিকিৎসা সেবার নাম্বার ও সহায়তা পাবার প্রক্রিয়া
২। প্রবাসী বাংলাদেশীরা প্রবাসী হেল্পলাইনের সাইটে চ্যাটবক্স বা ফেইসবুক চ্যাটবক্সে অথবা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে তাদের ফোন নম্বর ও সমস্যার কথা শেয়ার করলে আমাদের দেশের ডাক্তার, মনোসামাজিক কাউন্সিলর তাদের সাথে সরাসরি ফোনে (হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ভাইবার) এ কথা বলেন এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দেন
৩। সেচ্ছাসেবীরা ফলোআপ কলের মাধ্যমে (হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ভাইবার) এ কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সাধারণ স্বাস্থ্য জিজ্ঞাসা বা পরামর্শ দিয়ে থাকেন
৪। যে সব স্বাস্থ্যসেবা/সমস্যার সমাধান প্রবাসী হেল্পলাইন দিতে পারে না সেগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অন্যান্য টেলিমেডিসিন সেবা প্রদানকারীদের কাছে রেফার করা হয়
৫। দেশে ও বিদেশে ১৭ জন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন।
যেসব বেসরকারি সংস্থা কোভিড-১৯ বিষয়ক জরুরী দূরচিকিৎসা সেবা ও পরামর্শ দিয়ে থাকে তাদের মধ্যে আছেঃ হিউম্যান হেলথ হেল্পলাইন টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল হেলথকেয়ার ফাউন্ডেশন, কুইক মেড, মিলভিক বাংলাদেশ, অলওয়েল ডিজিটাল হাসপাতাল, জীয়ন, পালস হেলথকেয়ার সার্ভিসেস, প্রাভা বাংলাদেশ, টনিক ডিজিটাল হেলথকেয়ার সলিউশন্স ইত্যাদি।
অতিসম্প্রতি সরকারি এবং বেসরকারি টেলিমেডিসিন সেবার বাইরে দলীয় সেবার আওতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ‘জয় বাংলা টেলিমেডিসিন অ্যাপ’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে। এটি সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক টেলিমেডিসিন অ্যাপ যা শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা বিশ্বে এই প্রথম। এই অ্যাপ ব্যবহার করে দেশের মানুষ ভিডিও কলের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছ থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা নিতে পারবেন।
প্রথাগত চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি টেলিমেডিসিন সেবা স্বাস্থ্যসেবা খাতের অপ্রতুলতা এবং চাপ কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে তার জন্য দরকার ব্যাপক প্রচার। প্রচারের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্যসেবাকে হাসপাতাল থেকে আপনার ঘরে নিয়ে আসা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
প্রতিবেদনঃ এমদাদুল হক বাদল