
এরিক হ্যামিলটন, উইনকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়
২০১৪ সালে ডুডলি ল্যামিং অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণা পড়ছিলেন যেটি ছিল কিভাবে ইঁদুর অনেকগুলো নিয়ন্ত্রিত খাবার গ্রহনের ফলে সাড়া দিয়ে থাকে সেটির উপর। গবেষণায় একটি বিষয় তাঁর মনোযোগ আকৃষ্ট করে আর তা হলো সেই ইঁদুরগুলো ছিল সবচেয়ে বেশী সুস্বাস্থ্যের অধিকারী যাদের কম পরিমান প্রোটিন খেতে দেয়া হয়।
ইউনিভারসিটি অফ উইসকনসিনের স্কুল অফ মেডিসিন এন্ড পাবলিক হেলথের জারক বিষয়ক গবেষক ল্যামিং বলেন “অনেক ধরনের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্যের বিপরীত হওয়ায় বিষয়টি ছিল কৌতূহলোদ্দীপক”।
এরপর হতে ল্যামিং এবং তাঁর ছাত্ররা অস্ট্রেলিয়ার গবেষণা করা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন আর তা হলো “কম প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার কেনো প্রাণীদের সুস্বাস্থ্যের কারন হতে পারে?”
তাঁরা প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে একটি অচেনা কিন্তু বলিষ্ঠ প্যটারন খুঁজে পান। তিন চেইন বিশিষ্ট এমাইনো এসিড অর্থাৎ বিসিএএ সমৃদ্ধ খাবারের সাথে ডায়াবেটিস, স্থলতা এবং জারক সংক্রান্ত অন্যান্য অসুস্থতার সম্পর্ক রয়েছে। অপরদিকে সল্প পরিমাণে বিসিএএ সমৃদ্ধ খাবার এ সকল জারক সংক্রান্ত ব্যাধিকে কমাতে সহায়ক এমনকি ইঁদুরদের আয়ু বৃদ্ধিতেও সহায়তা করেছে।
তবে, এটি এখনও পরিষ্কার নয় যে বিসিএএ কিভাবে জারক প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রন করে যদিও বিসিএএ গ্রহন কমাতে পারলে জারক প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়ে এবং রক্তে চিনির পরিমান নিয়ন্ত্রনে থাকে। মানবদেহে খাদ্য সংক্রান্ত গবেষণার প্রচুর জটিলতার কারনে মানুষের মধ্যে বিসিএএ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করলে কি ঘটে তা এখনও জানা যায়নি।
তবে, গবেষণাটি আমরা কী খেতে পারি এ সম্পর্কে আমাদের ভিন্নভাবে চিন্তা করতে সমর্থ করেছে। কেনোনা গবেষণায় দেখা যায় যে কম প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার জারক প্রক্রিয়া কে নতুন করে প্রোগ্রাম করে এমনকি প্রাণীরা যখন একই অথবা অধিক পরিমান ক্যালোরী গ্রহন করেছে সে সময়টাতেও।
ল্যামিং বলেন “নতুন একটি উপলপধির সৃষ্টি হচ্ছে এই মর্মে যে ক্যালোরী শুধুমাত্র ক্যালোরী নয় বরং এটিতে কী রয়েছে এর বাইরেও ক্যালোরীর রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। আমাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে অন্যান্য ক্যালোরীর মত প্রোটিন ক্যালোরী এক জিনিস নয়”।
কমই অধিক
ক্যালোরী এবং প্রোটিনের উপর নিষেধাজ্ঞার ফলে উপকারিতার প্রমান প্রায় এক শতক পূর্বে পাওয়া যায় এবং এই বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। ২০০৯ সালে ইউডব্লিউ-ম্যডিসন গবেষকরা দেখতে পান যে দীর্ঘ মেয়াদী সল্প ক্যলোরীর খাবার গ্রহন্ করে রেসাস জাতীয় বানরেরা বেশী দিন বাঁচে। অন্যান্য প্রাণীদের উপর পরিচালিত গবেষণাতেও একই ধরনের ফলাফল পাওয়া যায়।
কম প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খুব বেশী মানুষ পছন্দ করে না। তবে, এমনটি দেখা গিয়েছে যে ক্যালোরী কমানোর উপকারিতা কম পরিমান প্রোটিন গ্রহনের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব। এই উপকারিতাগুলো প্রাণীরা ইচ্ছামত খাওয়ার পরও লক্ষণীয় ছিল।
এই বছরের শুরুতে প্রকাশিত দুটি গবেষণায় ল্যামিং এবং তাঁর সহযোগী যথাক্রমে নিকোল রিচার্ডসন এবং দেয়াং ইউ গুচ্ছাকৃত চেইন আকারের এমিনো এসিড কমানোর প্রভাবের উপর আলোকপাত করেন। বিসিএএ গুলো মানুষের জন্য অতিব প্রয়োজনীয় নয়টি এমিনো এসিডের মধ্যে তিনটি তৈরি করতে পারে। এই এমিনো এসিডগুলো মানবদেহে নিজ থেকে তৈরি হয় না। এই এমিনো এসিডগুলোতে রয়েছে গাছের মত ডালপালা যা তাঁদের নাম হতে অনুধাবন করা যায়।
জানুয়ারি তে প্রকাশিত এক গবেষণায় রিচার্ডসন ইঁদুরের উপর এক ধরনের খাবারের মাধ্যমে পরীক্ষা চালান যেটিতে প্রয়োজনীয় পরিমানের তিন ভাগের একভাগ বিসিএএ ছিল। এটি কোন ক্যালোরী সীমাবদ্ধ খাবার ছিল না। প্রাণীরা যত খুশি ততো খেয়েছিল এটি।
যে পুরুষ ইঁদুরগুলো তাঁদের জীবনভর এই খাবারটি গ্রহন করে, সেগুলো অন্যদের তুলতায় গড়ে ৩০% বেশী অর্থাৎ প্রায় আট মাস বেশী বেঁচেছিল। এটি পরিষ্কার নয় কেনো মেয়ে ইঁদুরগুলো এই খাবারে উপকৃত হয়নি তবে অন্যান্য গবেষণায় দেখা যায় যে মেয়ে ইঁদুরদের মধ্যে সল্প বিসিএএ গ্রহনের উপকার পেতে সামান্য ভিন্ন খাবারের প্রয়োজন হতে পারে।
ল্যামিং বলেন লিঙ্গের তফাতটি আমাদের কাছে খুবই আশ্চর্যজনক ছিল। পূর্বের প্রায় সকল গবেষণা পুরুষ ইঁদুরদের উপর করা হয়। এই ফলাফল এ জাতীয় গবেষণা উভয় লিঙ্গের উপর করার প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দেয়।
যদিও পুরুষ ইঁদুরদের মধ্যে বিসিএএ দ্বারা সক্রিয় হয় এমন একটি বায়োকেমিক্যাল পাথওয়ের অর্থাৎ এমটর কে কম সক্রিয় দেখা যায়। অনেক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এমটরের কর্মকাণ্ড কমিয়ে দেয় এমন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জারক প্রক্রিয়ার উন্নতির পাশাপাশি আয়ু বৃদ্ধি পেতে পারে।
মে মাসে প্রকাশিত অপর এক গবেষণায় ইয়ু এবং রিচার্ডসন আরো গভীরে আলোকপাত করেন। তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন শরীরের উপর তিন ধরনের বিসিএএ অর্থাৎ লিউসাইন, আইসোলিউসাইন এবং ভ্যলাইনের প্রভাব দেখতে এবং এগুলো এক সাথে কাজ করে কিনা।
ল্যামিং বলেন “আমরা দেখতে পেলাম আইসোলিউকাইন সীমাবদ্ধতার প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশী”। যেসব ইঁদুরদের সল্প প্রমান আইসোলিউকাইন খেতে দেওয়া হয় সুগুলো ছিল পাতলা গড়নের এবং তাঁদের শর্করার জারক প্রক্রিয়া ছিল স্বাভাবিক। কম ভ্যলাইন সমৃদ্ধ খাবারের প্রভাব ছিল একই রকম তবে দুর্বল মাত্রার। লিউকাইনের পরিমান কমানোর কোন উপকারিতা পাওয়া যায়নি এবং এটি ক্ষতিকারক হতেও পারে।
বিসিএএ’র সাথে স্থলতার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণায় গবেষকরা ইঁদুরদের পশ্চিমা খাবার খেতে দেন। এই খাবারে প্রচুর চর্বি এবং শর্করা ছিল। এই খাবার গ্রহনের পর কয়েক মাসের মধ্যে ইঁদুরগুলো স্থল হয়ে যায়।
ল্যামিং এর দল যখন এই স্থল ইঁদুরগুলোকে কম আইসোলিউকাইন সমৃদ্ধ পশ্চিমা খাবার খেতে দিয়েছিল, ইঁদুরগুলো প্রচুর পরিমানে খেলেও সেগুলোর ওজন কমেছিল। জারক প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ার ফলে ইঁদুরগুলোর ওজন কমে যায় এবং এতে করে ইঁদুরগুলো বিশ্রাম নেওয়ার সময় শরীর প্রচুর ক্যালোরী তাপের আকারে পুড়িয়ে ফেলে।
ল্যামিং এর দল এক্ষেত্রে মানবদেহকে গবেষণা করতে এসএমপিএইচ’র পপুলেশন হেলথের অধ্যাপক ক্রিস্টেন মালেকি এবং তাঁর দলের সাথে কাজ করে। তাঁরা আঁশসমৃদ্ধ দুগ্ধজাত খাবার এবং অংশগ্রহনকারীদের ওজনের উপর বিশ্লেষণ করেন।
একজন ব্যক্তি কী পরিমান এমাইনো এসিড গ্রহন করেছেন তা হিসেব করার মাধ্যমে তাঁরা দেখতে পান আইসোলিউসাইন অধিক পরিমানে গ্রহনের সাথে বডি মাস ইনডেক্স বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে যা গবেষকরা ইদুরের উপর পরিচালিত গবেষণায় আভাস দিয়েছিলেন।
খাবার নিয়ে পুনরায় ভাবুন
ল্যামিং মনে করেন তাঁর গবেষণার ফলাফল অনেকটাই স্ববিরোধী। অনেক আধুনিক খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত পরামর্শে প্রোটিন কমানোর পরিবর্তে যোগ করতে বলা হয়ে থাকে। প্রোটিন একধরনের পূর্ণতা দিয়ে থাকে যেটি মানুষকে ক্যলোরী নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে থাকে। প্রয়োজনীয় এ সকল এমাইনো এসিডগুলো খেলোয়াড়দের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যারা কিনা তাঁদের পেশী গঠন ও মেরামত করে থাকেন।
তবে আমেরিকার জনসংখ্যার বেশীরভাগ স্থুলতা এবং বসে কাটানোয় ল্যামিং মনে করেন খাদ্যাভ্যাস নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখার সুযোগ এসেছে। তিনি বলেন “মানুষ কম ক্যলোরী সমৃদ্ধ খাবার দীর্ঘদিন গ্রহন করতে অভ্যস্ত নয়”। তবে, প্রাণীদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে দেখা যায় যে কম প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার বিপাকপ্রক্রিয়াকে নতুন করে প্রোগ্রামিং এর মাধ্যমে চর্বি কমাতে সাহায্য করে।
তবে, মানবদেহে কম প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েই যায়। নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের উপর ল্যামিং যেভাবে ইঁদুরদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা পরিচালনা করেছেন তা মানুষের উপর করা প্রায় অসম্ভব। তবে, ল্যামিং এবং অন্যান্যরা লো বিসিএএ ডায়েট নিয়ে মানুষের উপর ছোট আকারের পরীক্ষা করছেন।
এমনকি একটি লো বিসিএএ ডায়েট তৈরি করাও বেশ কঠিন কাজ। নিরামিষভোজিদের খাদ্যে সাধারণত বিসিএএ কম থাকে এবং প্রাণী হতে প্রাপ্ত প্রোটিন বেশী থাকে। তবে, লো আইসোলিউসাইন ডায়েট তৈরিতে আরো গবেষণার প্রয়োজন। আমেরিকানরা প্রয়োজনের চেয়ে অধিক প্রোটিন গ্রহন করে থাকেন এ কারনে তাঁদের এই অভ্যাস পরিবর্তন বেশ কঠিন হতে পারে।
ল্যামিং বলেন “আমরা দেখেছি আপনি খাবারে কী কী গ্রহন করছেন সেটি আপনার স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং আয়ুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং আমি মনে করি যে আমরা এমন একটি খাবার খুঁজে পাওয়ার পথে রয়েছি যা মানুষ ক্যালোরী না কমিয়ে গ্রহন করতে পারবে এবং এতে করে তাঁরা দীর্ঘদিন সুস্বাস্থ্যের সাথে বেঁচে থাকতে পারবে”।