
হঠাৎ করে হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম বন্ধ হওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং জ্ঞান হারানো হলো সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট। এ সমস্যাটি হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার ত্রুটির কারনে হয়ে থাকে এবং এ কারনে আপনার হৃদযন্ত্রের রক্ত পাম্প করার সক্ষমতা ব্যহত হয় এবং শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
তবে, সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট এবং হার্ট এটাক এক জিনিস নয়। হার্ট এটাকে আপনার হৃদযন্ত্রের একটি অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে, মাঝে মাঝে হার্ট এটাকের কারনে হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা বিঘ্নিত হতে পারে এবং এ কারনে সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট হতে পারে।
তাৎক্ষনিকভাবে চিকিৎসা না করালে সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট মৃত্যুর কারনও হতে পারে। তবে, দ্রুততম সময়ে কার্যকর চিকিৎসার মাধ্যমে জীবন রক্ষা করা সম্ভব। জরুরী সাহায্য প্রাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত ডিফিব্রিল্লেটর ব্যবহার করে অথবা বুকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থাৎ কার্ডিওপালমুনারী রিসাসসিটেশনের (সিপিআর) মাধ্যমে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করা যায়।
উপসর্গসমূহ
সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্টের লক্ষণগুলো হয়ে থাকে তাৎক্ষনিক এবং ভয়াবহ। এগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
- হঠাৎ চেতনা হারানো
- নাড়িস্পন্দন না থাকা
- শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া
- জ্ঞান হারানো
কখনো কখনো অন্যান্য লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্টের পূর্বেই হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে থাকতে পারেঃ
- বুকে অস্বস্তি বোধ করা
- শ্বাসকষ্ট
- দুর্বলতা
- দ্রুত হৃদস্পন্দন
তবে সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট কোন রকম সতর্কতা ছাড়াই ঘটে যেতে পারে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন
- বুকে ব্যথা অথবা অস্বস্তি হলে
- ঘন ঘন হৃদস্পন্দন হলে
- দ্রুত অথবা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হলে
- হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হলে
- জ্ঞান হারালে অথবা জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলে
- মাথা ঘোরালে
হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলে মুহূর্তের ভেতর রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতির কারনে মৃত্যু অথবা মস্তিষ্কের চিরস্থায়ী ক্ষতিসাধন হতে পারে। সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যখন আপনি একজন ব্যক্তিকে সহায়তা করছেন যিনি জ্ঞান হারিয়েছেন এবং শ্বাস প্রশ্বাস নিতে পারছেন না।
যদি কেউ আপনার দৃষ্টিগোচর হয় যিনি জ্ঞান হারিয়েছেন এবং স্বাভাবিকভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিছেন না তবে নিম্নে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো গ্রহন করুনঃ
- জরুরী স্বাস্থ্য সেবার জন্য ৯৯৯ এ ফোন দিনঃ আপনার হাতের কাছে টেলিফোন থাকলে সিপিআর আরম্ভের পূর্বেই ফোন দিন।
- সিপিআর আরম্ভ করুনঃ মানুষটির শ্বাস প্রশ্বাসের অবস্থা দ্রুত পরখ করে নিন। যদি তিনি স্বাভাবিকভাবে শ্বাস প্রশ্বাস না করেন তবে সিপিআর আরম্ভ করুন। ব্যাক্তির বুকের উপর দ্রুত এবং জোড়ের সাথে চাপ প্রয়োগ করুন – মিনিটে ১০০ থেকে ১২০ টি চাপ। সিপিআর এর উপর আপনার প্রশিক্ষণ নেয়া থাকলে অসুস্থ ব্যাক্তির শ্বাস প্রশ্বাসের পথটি দেখে নিন এবং প্রতি ৩০বার চাপ দেবার পর মুখ দিয়ে শ্বাস দিন।যদি আপনার প্রশিক্ষণ না নেয়া থাকে তবে বুকের উপর চাপ দিতে থাকুন। লক্ষ্য রাখুন দুবার চাপ দেয়ার মধ্যবর্তী সময়ে বুক যেনো পুরোপুরি উঠতে পারে। একটি পোর্টেবল ডিফিব্রিল্লেটর অথবা জরুরী সেবা প্রদানকারীরা উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত এমনটি করতে থাকুন।
- পোর্টেবল ডিফিব্রিল্লেটর ব্যবহার করুন যদি হাতের কাছে থাকে। এ যন্ত্রটি আপনাকে ব্যবহারের প্রতিটি ধাপ সম্পর্কে অবহিত করবে। ডিফিব্রিল্লেটর চার্জ হওয়ার সময় বুকে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখুন। চার্জ সম্পূর্ণ হলে ডিফিব্রিল্লেটর অসুস্থ ব্যাক্তির হৃদস্পন্দন পরীক্ষা করবে এবং শকের প্রয়োজন হলে অবহিত করবে। যন্ত্রটি শক প্রয়োগের সুপারিশ করলে একটি শক প্রয়োগ করুন এবং তাৎক্ষনিকভাবে বুকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে সিপিআর আরম্ভ করুন অথবা দুই মিনিটের জন্য বুকে চাপ দিন।
ডিফিব্রিল্লেটর ব্যবহারের সময় অসুস্থ ব্যাক্তির হৃদস্পন্দনের দিকে লক্ষ্য রাখুন। প্রয়োজন হলে এই ডিফিব্রিল্লেটর আরেকটি শক প্রয়োগ করবে। জরুরী সাহায্য আসা পর্যন্ত অথবা অসুস্থ ব্যাক্তির জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত এমনটি করতে থাকুন।
আজকাল অনেক স্থানেই যেমনঃ বিমানবন্দরে, ক্যসিনোতে এবং শপিং মলে পোর্টেবল অটোমেটেড এক্সটারনাল ডিফিব্রিল্লেটর (এইডি) থাকে। আপনি এমন একটি যন্ত্র বাসায় কিনে রাখতে পারেন। এইডিতে ব্যবহারবিধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেয়া থাকে। এটি শুধুমাত্র তখনই শক প্রয়োগ করবে যখন প্রয়োজন হবে।
কারনসমূহ
সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট সাধারণত অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের (এরিদমিয়া) কারনে হয়ে থাকে। আপনার হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ঠিকমত কাজ না করলে এমনটি হয়ে থাকে।
হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা আপনার হৃদযন্ত্রের কম্পনের হার এবং কম্পনকে নিয়ন্ত্রন করে। যদি কোন সমস্যা দেখা দেয় তবে আপনার হৃদযন্ত্র খুব দ্রুত, ধীরে অথবা অনিয়মিতভাবে স্পন্দন করতে পারে(এরিদমিয়া)। কখনো কখনো এরিদমিয়া খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হয়ে থাকে এবং এটি ক্ষতিকারক নয় কিন্ত কোন কোন ধরনের এরিদমিয়া সাদেন কার্ডিয়াক এরেস্ট ঘটাতে পারে।
কার্ডিয়াক এরেস্টের সময় সচরাচর হৃদপিন্ডের নীচের প্রকোষ্ঠে এরিদমিয়া হয়ে থাকে। দ্রুত, অনিশ্চিত বৈদ্যুতিক তাড়নার ফলে আপনার হৃদপ্রকোষ্ঠতে রক্ত পাম্প করার পরিবর্তে অকারনে কাঁপুনি হয়ে থাকে (ভেন্ট্রিকেল ফাইব্রিল্লেসন)।
যে সকল হৃদরোগের কারনে সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট হতে পারে
যাদের জানামতে কোন হৃদরোগ নেই তাদের সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট হতে পারে। তবে, কারো পূর্বে কোন হৃদরোগের চিকিৎসা করা না হলে এরিদমিয়া হতে পারে যা কিনা প্রানহানির কারন হতে পারে। এ সকল রোগের মধ্যে রয়েছেঃ
- করোনারি হার্ট ডিজিসঃ যাদের করনারি আরটারি ডিজিস রয়েছে তাদের অনেকেরই সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ধমনীগুলো কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য জমে যাওয়া জিনিসের মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যায় এবং এর ফলে হৃদযন্ত্রে রক্ত প্রবাহ কমে যায়।
- হার্ট এটাকঃ জটিল করোনারি হার্ট ডিজিসের কারনে হার্ট এটাক হয়ে থাকলে ভেন্ট্রিকুলার ফাইব্রিল্লেসন এবং সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট হতে পারে। এছাড়া হার্ট এটাকের কারনে আমাদের হৃদযন্ত্রের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত কোষের আশে পাশে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের কারনে অস্বাভাবিক হৃদকম্পন হতে পারে।
- হৃদপিন্ড বড় হয়ে যাওয়া (কার্ডিওমায়োপ্যাথি)- আপনার হৃদপিন্ডের দেয়ালের পেশী প্রসারিত অথবা ঘন হয়ে গেলে এ রোগটি হয়ে থাকে। এর ফলে আপনার হৃদযন্ত্রের কোষগুলো অস্বাভাবিক হয়ে যায় এবং এরিদমিয়া হয়ে থাকে।
- ভালভিউলার হার্ট ডিজিসঃ আপনার হৃদপিন্ডের ভাল্বগুলো সরু হয়ে গেলে অথবা ফুঁটা হয়ে গেলে হৃদপিন্ডের পেশী প্রসারিত অথবা ঘন হয়ে যেতে পারে। ফুটা হয়ে যাওয়া অথবা সংকুচিত হয়ে যাওয়া ভাল্বের কারনে যখন হৃদযন্ত্রের প্রকোষ্ঠগুলো প্রসারিত হয় তখন আরিদমিয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
- জন্মগত হৃদযন্ত্রের সমস্যাঃ বাচ্চাদের অথবা কিশোরদের সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট হলে জন্মগত হৃদরোগের কারনে হতে পারে। জন্মগত হৃদরোগ অস্ত্রপচারের মাধ্যমে সাড়ানো গেলেও সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্টের উচ্চ ঝুঁকি রয়ে যায়।
- হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় সমস্যাঃ কারো কারো ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্রের পেশী অথবা ভাল্বে সমস্যা না হয়ে হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় সমস্যা হয়ে থাকে। এ অবস্থাকে বলা হয় প্রাইমারি হার্ট রিদম এবনরমালিটিস এবং ব্রুগাডা সিনড্রোম এবং লং কিউ টি সিনড্রোম এ কারনে হয়ে থাকে।
ঝুঁকি সৃষ্টিকারী বিষয়সমূহঃ

যেহেতো সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্টের সাথে করোনারি আরটারি ডিজিজের সম্পৃক্ততা রয়েছে তাই করোনারি আরটারি ডিজিজের ঝুঁকি বৃদ্ধিকারী কারনসমূহ সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্টেরও ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এ সকল কারনগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
- পরিবারে করোনারি আরটারি ডিজিজের ইতিহাস থাকলে।
- ধূমপান
- উচ্চ রক্তচাপ
- রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশী হলে
- স্থলতা
- ডায়াবেটিস
- অলস জীবনযাপন
অন্যান্য যেসব কারনে সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্টের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে সেসবের মধ্যে রয়েছেঃ
- ইতিপূর্বে কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়ে থাকলে অথবা পরিবারে কার্ডিয়াক এরেস্টের ইতিহাস থাকলে
- ইতিপূর্বে হার্ট এটাক হয়ে থাকলে
- অন্যান্য হৃদরোগ থাকলে অথবা পরিবারে অন্যান্য হৃদরোগের ইতিহাস থাকলে যেমনঃ হার্ট রিদম ডিজ অরডারস, জন্মগত হার্টের সমস্যা, হার্ট ফেইলিউর এবং কার্ডিওমায়োপ্যথী
- বয়স বেড়ে যাওয়া-বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্টের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়
- যারা পুরুষ তাদের
- কোকেন অথবা এমফিটামিনের মত মাদক গ্রহন করলে
- পুষ্টির ভারসম্যহীনতার কারনে যেমনঃ শরীরে পটাসিয়াম অথবা ম্যগনেসিয়ামের ঘাটতি হলে
- অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ এপনিয়া থাকলে
- কিডনীর দীর্ঘমেয়াদী রোগ থাকলে
জটিলতাসমূহ
সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট ঘটলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যাওয়ার কারনে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। যদি হৃদপিন্ডের কার্যক্রম দ্রুত স্বাভাবিক না হয়ে আসে সে ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে এবং মৃত্যু ঘটতে পারে। যারা কার্ডিয়াক এরেস্ট হওয়ার পর বেঁচে যান, তাদের মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়ার লক্ষন থাকে।
কিভাবে এড়ানো সম্ভবঃ
নিয়মিতভাবে চেক আপ করার মাধ্যমে কোন হৃদরোগ আছে কিনা তা জানতে পারেন এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্টের ঝুঁকি কমাতে পারবেন।
রোগ নির্ণয়
আপনি যদি সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট হওয়ার পর বেঁচে যান তবে আপনার চিকিৎসক এর পেছনের কারন নির্ণয়ের চেষ্টা করবেন যেনো ভবিষ্যতে এমনটি আর না হয়। যে সকল পরীক্ষা আপনার চিকিৎসক করাতে বলতে পারেন এর মধ্যে রয়েছেঃ
ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি)
ইসিজির সময় আপনার বুক এবং কখনো কখনো হাতে ও পায়ে সেনসর স্থাপন করা হয় এবং এর মাধ্যমে আপনার হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা যায়। ইসিজির মাধ্যমে হৃদস্পন্দনে কোন সমস্যা থাকলে বোঝা যায় অথবা অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক প্যাটার্ন শনাক্ত করা যায়। যেমনঃ দীর্ঘ কিউটি ইন্টারভাল যা হঠাৎ মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়।
রক্ত পরীক্ষা
আপনার হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন কিছু হরমোন, ক্যমিক্যাল, পটাসিয়াম এবং সোডিয়ামের মাত্রা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা যেতে পারে। এছাড়া রক্তের অন্যান্য পরীক্ষার মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে হৃদযন্ত্রে কোন আঘাত অথবা হার্ট এট্যাকের ঘটনা শনাক্ত করা সম্ভব।
বিভিন্ন ধরনের ইমেজিং পরীক্ষা
এগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
- বুকের এক্সরেঃ বুকের এক্সরের মাধ্যমে চিকিৎসক আপনার হৃদপিন্ডে ও এর রক্তনালীর আকার এবং আকৃতি বুঝতে পারবেন। এর মাধ্যমে বোঝা যাবে আপনার হার্ট ফেইলিউর হয়েছে কিনা।
- ইকোকার্ডিওগ্রামঃ এই পরীক্ষাটিতে শব্দের ঢেউয়ের মাধ্যমে আপনার হৃদপিণ্ডের ছবি দেখা যায়। এই পরীক্ষাটির মাধ্যমে বোঝা যাবে আপনার হৃদপিন্ডের কোন অংশ কি হার্ট এটাকের কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা এবং আপনার হৃদপিন্ড ঠিকমত রক্ত পাম্প করছে কিনা এবং হৃদপিণ্ডের ভাল্বে কোন সমস্যা রয়েছে কিনা।
এই পরীক্ষার পাশাপাশি নিউক্লিয়ার স্ক্যান, এমআরআই, সিটি স্ক্যান এবং কার্ডিয়াক ক্যথেটারাইজেশনের মাধ্যমে ইজেকশন ফ্র্যাকশন পরিমাপের মাধ্যমে আপনার হৃদযন্ত্রের রক্ত পাম্প করার সক্ষমতা বোঝা যায়। ইজেকশন ফ্র্যাকশনের মাধ্যমে আপনি কার্ডিয়াক এরেস্টের কতটা ঝুঁকিতে রয়েছেন সেটি বোঝা যায়। প্রতিটি হৃদস্পন্দনের সময় কত শতাংশ রক্ত একটি পরিপূর্ণ ভেন্ট্রিকেল থেকে বেরিয়ে আসে সেটি বোঝা যায়।
সাধারণত ইজেকশন ফ্র্যাকশন ৫০% থেকে ৭০% হয়ে থাকে। তবে এটি যদি ৪০% এর কম হয় তবে আপনার সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্টের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে।
- নিউক্লিয়ার স্ক্যান- এটি একটি স্ট্রেস টেস্টের মাধ্যমে করা হয় এবং এর মাধ্যমে হৃদযন্ত্রে রক্ত চলাচলে সমস্যা থাকলে বোঝা যায়। এই পরিক্ষায় সামান্য পরিমান তেজস্ক্রিয় পদার্থ যেমনঃ থ্যালিয়াম রক্তে প্রবেশ করানো হয়। বিশেষ ক্যামেরার মাধ্যমে তেজস্ক্রিয় পদার্থটি আপনার হৃদপিণ্ড এবং ফুসফুস দিয়ে চলাচলের সময় সেটিকে শনাক্ত করা হয়।
- করোনারি ক্যথেরাইজেশন-এই প্রক্রিয়ায় আপনার হৃদযন্ত্রের ধমনিতে একটি সরু লম্বা টিউবের (ক্যথেটার) মাধ্যমে তরল রং প্রবেশ করানো হয়। সাধারনত হাতের ধমনির মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের ধমনিতে পৌছানো হয়। তরল জিনিসটি আপনার ধমনীকে পরিপূর্ণ করলে ধমনীগুলো এক্সরে এবং ভিডিও টেপে দৃশ্যমান হয় এবং কোন ব্লক থাকলে তা ধরা পড়ে।
ক্যথেটারটি সংযুক্ত অবস্থায় চিকিৎসক ধমনীটি উন্মুক্ত করে একটি স্টেন্ট ঢুকিয়ে ধমনীটি প্রসারিত করেন। একে বলা হয় এনজিওপ্লাস্টি।
চিকিৎসা
সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়ে থাকলে জীবন বাঁচাতে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নিতে হবে
সিপিআর
সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট হলে তাৎক্ষনিকভাবে সিপিআর প্রদান করা খুবই জরুরী। উন্নত জরুরী সেবা প্রাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে অক্সিজেন সম্পন্ন রক্ত প্রবাহ বজায় রেখে সিপিআর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আপনি যদি না জানেন কিভাবে সিপিআর দিতে হয় এবং যদি কাউকে জ্ঞান হারাতে দেখেন তবে জরুরী সাহায্যের জন্য ৯৯৯ এ ফোন করুন। যদি অসুস্থ ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস না নিয়ে থাকেন তবে তার বুকে জোড়ে এবং দ্রুততার সাথে চাপ দিন-মিনিটে ১০০ থেকে ১২০টি এবং প্রতি বার চাপের মধ্যেবর্তী সময় বুক যেনো পুরোপুরি উঠতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। জরুরী সেবা প্রদানকারীরা না আসা পর্যন্ত অথবা অটোমেটেড এক্সটারনাল ডিফিব্রিল্লেটর (এইডি) না পাওয়া পর্যন্ত এমনটি করতে থাকুন।
ডিফিব্রিল্লেসন
এক ধরনের এরিদমিয়া অর্থাৎ ভেন্ট্রিকুলার ফাইব্রিল্লেসনের কারনে সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট হতে পারে। ডিফিব্রিল্লেশনের মাধ্যমে বুকের মধ্যে দিয়ে হৃদপিন্ডে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। ডিফিব্রিল্লেসন নামক এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হৃদপিন্ড এবং এর মধ্যেকার গোলযোগকে সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করা হয়। এর ফলে স্বাভাবিক হৃদস্পন্দন পুনরায় আরম্ভ হয়।
ডিফিব্রিল্লেটরের মাধ্যমে ভেন্ট্রিকুলার ফাইব্রিল্লেসন শনাক্ত করা হয় এবং প্রয়োজনবোধে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। আজকাল বিভিন্ন স্থানে যেমনঃ পাবলিক প্লেস, বিমানবন্দর, শপিং মল, ক্যসিনো, হেলথ ক্লাব এবং সিনিয়র সিটিজেন সেন্টারে এরকম পোর্টেবল ডিফিব্রিল্লেটর দেখা যায়।
জরুরী বিভাগে
জরুরী বিভাগে আসার পর স্বাস্থ্যকর্মীরা আপনার অবস্থা স্থিতিশীল করার চেষ্টা করবেন এবং সম্ভাব্য হার্ট এটাক, হার্ট ফেইলিউর অথবা বিভিন্ন খনিজ পদার্থের ভারসম্যহীনতার চিকিৎসা করবেন। এ সময় হৃদপিণ্ডের ক্রিয়াকে স্বাভাবিক করতে আপনাকে ঔষধ দেয়া হতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা
সুস্থ হবার পর আপনার চিকিৎসক আপনার সাথে এবং আপনার পরিবারের সাথে আলাপ করে নির্ধারণ করবেন কার্ডিয়াক এরেস্টের কারন নির্ণয়ে আর কী পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। এ সময় আপনার চিকিৎসক আরো একটি কার্ডিয়াক এরেস্ট এড়াতে কী করতে হবে তা নিয়েও আপনার সাথে আলোচনা করবেন।
এ সময়ের চিকিৎসার মধ্যে রয়েছেঃ
- ঔষধ– এরিদমিয়ার জরুরী অথবা দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসায় চিকিৎসকেরা বিভিন্ন ধরনের এন্টি-এরিদমিক ঔষধ ব্যবহার করেন। বেটা ব্লকার নামে এক জাতীয় ঔষধ যাদের সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্টের ঝুঁকি রয়েছে তাদের উপর ব্যবহার করা হয়।
এ জাতীয় অবস্থার চিকিৎসায় অন্যান্য যেসব ঔষধ ব্যবহার করা হয় এর মধ্যে রয়েছে এনজিওটেন্সিন-কনভারটিং এনজাইম (এসিই) ইনহিবিটরস এবং ক্যলসিয়াম চ্যানেল ব্লকারস।
- ইমপ্ল্যান্টাবল কার্ডিওভারটার-ডিফিব্রিল্লেটর (আইসিডি)- আপনার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হলে চিকিৎসক একটি আইসিডি ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন। এটি একটি ব্যটারি চালিত ইউনিট যেটি আপনার শরীরের বাম দিকের কলার বোনের কাছে স্থাপন করা হয়। আইসিডির ইলেক্ট্রোড থেকে এক বা একাধিক তার আপনার হৃদযন্ত্রে শিরার মাধ্যমে পৌঁছানো হয়।
আইসিডি একনাগারে আপনার হৃদস্পন্দন পর্যবেক্ষণ করে। যদি কোন হৃদস্পন্দন খুব দুর্বল হয়ে থাকে তবে এই যন্ত্রটি পেসমেকারের মত আপনার হৃদপিণ্ডের গতি বাড়িয়ে দেয়। এটি বিপদজনক হৃদস্পন্দনের পরিবর্তন শনাক্ত করে এবং সল্প ও উচ্চ ক্ষমতার শক প্রদানের মাধ্যমে আপনার হৃদযন্ত্রের স্পন্দন কে স্বাভাবিক করে।
করোনারি এনজিওপ্লাস্টি- এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যাওয়া করোনারি আরটারিগুলো খুলে দেয়া হয় এবং এর ফলে হৃদযন্ত্রে রক্ত সহজে চলাচল করতে পারে। সেই সাথে জটিল এরিদমিয়ার ঝুকিও হ্রাস পায়। আপনার পায়ের কোন একটি ধমনী দিয়ে একটি লম্বা ও সরু টিউব আপনার হৃদযন্ত্রের বন্ধ হয়ে যাওয়া ধমনীতে পৌঁছানো হয়। এই ক্যথেটারের সাথে একটি বিশেষ ধরনের বেলুন সংযুক্ত থাকে যা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ফুলিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ধমনী খুলে দেয়া হয়।
একই সময় একটি ধাতুর তৈরি স্টান্ট ধমনীতে প্রবেশ করানো হয় যেন এটি দীর্ঘ সময়ের জন্য খোলা থাকে এবং এর মাধ্যমে হৃদযন্ত্রে রক্ত চলাচল পুনরায় আরম্ভ হয়। করোনারি এনজিওপ্লাস্টি এবং করোনারি ক্যথেরাইজেশন একই সময় করা যায়। করোনারি ক্যথেরাইজেশন একটি প্রক্রিয়া যেটির মাধ্যমে চিকিৎসকেরা হৃদপিণ্ডে সরু হয়ে যাওয়া ধমনী খুঁজে থাকেন।
- করোনারি বাইপাস সার্জারি-এটিকে বলা হয় করোনারি আরটারি বাইপাস গ্রাফটিং যেখানে বন্ধ হয়ে যাওয়া শিরা অথবা ধমনীর স্থান এড়িয়ে সেলাইয়ের মাধ্যমে হৃদপিন্ডে রক্ত চলাচল পুনরায় চালু করা হয়। এর ফলে হৃদযন্ত্রে রক্ত চলাচলের উন্নতি হয় এবং দ্রুত হৃদস্পন্দন কমে আসে।
- রেডিওফ্রিকুয়েন্সি ক্যথেটার এবলেশন- এই প্রক্রিয়ায় একটি অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক পথ বন্ধ করা হয়ে থাকে। আপনার হৃদযন্ত্রের অভ্যন্তরে রক্তনালীগুলোতে এক বা একাধিক ক্যথেটার প্রবেশ করানো হয়। এরিদমিয়ার কারন হতে পারে এমন বৈদ্যুতিক পথ বরাবর এই ক্যথেটারগুলো স্থাপন করা হয়।
ক্যথেটারের মাথায় অবস্থিত ইলেক্ট্রোডগুলো রেডিওফ্রিকুয়েন্সি শক্তির মাধ্যমে গরম করা হয়। এর মাধ্যমে সামান্য পরিমান হৃদপিণ্ডের কোষ ধংস করা হয় এবং এরিদমিয়ার কারন হতে পারে এমন বৈদ্যুতিক পথে এক ধরনের বৈদ্যুতিক ব্লকের সৃষ্টি করা হয়।
- হৃদপিণ্ডে অস্ত্রোপচার– আপনার যদি জন্মগত হৃদযন্ত্রের সমস্যা থাকে যেমনঃ কার্ডিমায়োপ্যথীর কারনে ভাল্বে কোন সমস্যা অথবা হৃদপিন্ডের পেশীতে কোন সমস্যা, তবে অস্ত্রপচারের মাধ্যমে আপনার হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল এবং হৃদস্পন্দনের উন্নতি করা যায়। এর ফলে এরিদমিয়ার ঝুঁকি হ্রাস পায়।
জীবনযাপন এবং ঘরোয়া সমাধান
হৃদযন্ত্রের জন্য উপযোগী সুস্থ জীবন যাপন করতে হলেঃ
- ধূমপান পরিহার করতে হবে
- শরীরের ওজন স্বাভাবিক রাখতে হবে
- আপনি যদি মদপান করে থাকেন তবে তা নিয়ন্ত্রন করতে হবে। যেমনঃ নারীরা এবং যেসব পুরুষের বয়স ৬৫ বছরের অধিক তারা দিনে একবারের বেশী মদপান করতে পারবেন না এবং অল্পবয়স্করা দিনে দুবারের বেশী মদপান করবেন না।
- হৃদপিণ্ডের জন্য উপযোগী খাবার গ্রহন করুন।
- সচল থাকতে হবে।
- চাপ সামলাতে পারতে হবে।
ঔষধের মাধ্যমে
আপনার যদি ইতিমধ্যেই হৃদরোগ থেকে থাকে অথবা আপনি হৃদরোগের ঝুঁকিতে থেকে থাকেন তবে আপনার চিকিৎসক আপনাকে সুস্থ রাখতে কী করতে হবে তা বলে থাকতে পারেন যেমনঃ উচ্চ কোলেস্টেরল এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে ঔষধ সেবন করা।
যদি কোন হৃদরোগের কারনে আপনি সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্টের ঝুঁকিতে থাকেন তবে আপনার চিকিৎসক আপনাকে এন্টি-এরিদমিক ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন।
যন্ত্রের মাধ্যমে
আপনার যদি কার্ডিয়াক এরেস্টের ঝুঁকি থেকে থাকে তবে আপনার চিকিৎসক একটি ইমপ্লান্টেবল কার্ডিওভারটার-ডিফিব্রিল্লেটর ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন। এছাড়া বাসায় ব্যবহারের জন্য আপনি একটি অটোমেটেড এক্সটারনাল ডিফিব্রিল্লেটর কেনার কথা বিবেচনা করতে পারেন। এ ব্যাপারে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন। এইডি ব্যয়বহুল হতে পারে এবং স্বাস্থ্য বীমার আওতায় নাও আসতে পারে।
প্রশিক্ষণ
যদি সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্টের ঝুঁকি আছে এমন কেউ আপনার সাথে বসবাস করেন তবে আপনার সিপিআর’র উপর প্রশিক্ষণ থাকাটা জরুরী।
প্রশিক্ষণ নেয়া থাকলে শুধু আপনি আপনার প্রিয়জনের উপকারেই আসবেন না বরং এর মাধ্যমে অন্যরাও উপকৃত হবেন। যত বেশী মানুষ কার্ডিয়াক ইমারজেন্সিতে কী করতে হবে তা জানবে, ততো বেশী অধিক সংখ্যক মানুষ সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্টের পর বাঁচতে পারবে।