
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি গরম আবহাওয়া বিরাজমান। দেখে নেয়া যাক শরীরের উপর তাপপ্রবাহের প্রভাব সম্পর্কে আপনার কী কী জানা প্রয়োজন।
অতিরিক্ত তাপমাত্রা আমাদের শরীরে কী করে?
শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে রক্তনালীগুলো প্রশস্ত হয়ে যায়। এর ফলে শরীরের রক্তচাপ কমার কারনে হৃদপিণ্ডকে পুরো শরীরে রক্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। এর ফলে, রক্তনালী ছিদ্রযুক্ত হয়ে যাওয়ার কারনে শরীরে র্যাশ দেখা দিতে পারে এবং পা ফুলে যেতে পারে। একই সাথে ঘামের কারনে শরীর থেকে পানি ও খনিজ পদার্থ বের হয়ে যেতে পারে এবং শরীরের খনিজ পদার্থের ভারসম্যের তারতম্য ঘটে। সব মিলিয়ে তাপ নিঃসেষন ঘটতে পারে। তাপ নিঃসেষনের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
১। মাথা ঘোরা
২। বমি বমি ভাব
৩। জ্ঞান হারানো
৪। বিভ্রান্তি
৫। পেশীতে টান পড়া
৬। মাথা ব্যাথা
৭। অধিক পরিমানে ঘাম হওয়া
৮। ক্লান্ত বোধ করা
যদি রক্তচাপ আরো কমে যায়, তবে হার্ট এটাকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
আমাদের শরীর কেনো এমন প্রতিক্রিয়া দেখায়?
আমরা তুষারঝড়েই থাকি অথবা তাপদাহে থাকিনা কেনো, আমাদের শরীর তাপমাত্রা ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বজায় রাখার চেষ্টা করে।
আমাদের শরীরের তাপমাত্রা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আবহাওয়া উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে আমাদের শরীরকে তাপমাত্রা কম রাখার জন্য পরিশ্রম করতে হয়। এর ফলে আমাদের ত্বকের কাছাকাছি অধিক পরিমানে রক্তনালী উন্মোচিত হয়ে যায় যাতে করে শরীরের তাপ চারপাশে বেরিয়ে যেতে পারে এবং আমাদের ঘাম আরম্ভ হয়। ঘাম বাষ্পীভূত হওয়ার সাথে সাথে শরীরের তাপমাত্রা আশ্চর্যজনকভাবে কমতে আরম্ভ করে।
তাপমাত্রা শরীরের উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে?
শরীরে পানিশূন্যতা ঘটলে মাথা ঘুরতে পারে এবং জ্ঞান হারানোর মত মনে হতে পারে। এর ফলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় এবং আমাদের ত্বক অধিক পরিমানে ঘাম উৎপন্ন করে। ঘাম বাষ্পীভূত হওয়ার কারনে আমাদের ত্বক ঠাণ্ডা হয়। তবে, অধিক পরিমাণে রক্ত চলাচলের কারনে আমাদের পায়ের গোড়ালি ফুলে যেতে পারে।
কাউকে তাপ নিঃশেষনের শিকার হতে দেখলে আমার কী করা উচিত?
যদি শরীরের তাপমাত্রা আধঘণ্টার মধ্যে কমে যায়, তবে তাপ নিঃশেষন খুব একটা গুরুতর বিষয় নয়। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের উপদেশসমূহের মধ্যে রয়েছেঃ
আক্রান্ত ব্যাক্তিকেঃ
*ঠাণ্ডা স্থানে নিতে হবে
*শুইয়ে দিতে হবে এবং পা দুটো অল্প করে তুলে ধরতে হবে
*প্রচুর পানি পান করাতে হবে। এক্ষেত্রে স্পোর্টস ড্রিঙ্কস খাওয়ালেও চলবে
* ঠাণ্ডা পানি ছিটিয়ে অথবা স্পঞ্জ করে এবং বাতাসের মাধ্যমে শরীরের তাপমাত্রা কমাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ঘাড়ে এবং বগলের আশেপাশে কোল্ড প্যাক দেয়া যেতে পারে।
তবে, ৩০ মিনিটের মধ্যে আক্রান্ত ব্যাক্তি সুস্থ না হলে হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা রয়েছে। এটি একটি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরী অবস্থা এবং আপনার ৯৯৯ এ ফোন করা উচিত হবে।
হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধির পরও ঘামা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শরীরে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড অতিক্রম করতে পারে এবং এর ফলে আক্রান্ত ব্যাক্তির খিঁচুনি হতে পারে অথবা তিনি জ্ঞান হারাতে পারেন।
ছেলেটি ফুটবল খেলার সময় পানি পান করছে
কারা অধিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন?
বার্ধক্য অথবা হৃদরোগের মত দীর্ঘ মেয়াদী রোগের কারনে মানুষ শরীরের উপর অধিক তাপের প্রভাব মোকাবেলা করতে পারে না। ডায়াবেটিসের ফলে শরীর দ্রুত পানি হারাতে পারে এবং এই রোগের জটিলতার কারনে শরীরের রক্তনালীর তারতম্য ঘটে এবং ঘেমে যাওয়ার সক্ষমতা লোপ পায়।
যেসব মানুষ কম চলাফেরা করে তারাও এ ক্ষেত্রে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ডিমেনশিয়ার মত মস্তিষ্কের রোগের কারনে মানুষ শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্তন সম্পর্কে অবগত নাও হতে পারে এবং করণীয় বিষয়সমূহ নাও পালন করতে পারে।
এছাড়া গৃহহীন মানুষদের রোদে বেশী সময় কাটাতে হয়। যারা উপর তলায় অবস্থান করেন তাদেরও অধিক তাপমাত্রায় বসবাস করতে হয়।
অধিক তাপমাত্রায় কিভাবে ঘুমাবেন?
চা অথবা কফি কী পানিশূন্যতা ঘটায়?
সানক্রিমঃ কতটুকু ব্যবহার করা উচিত এবং রোদে পুড়ে গেলে কী করতে হবে
কিছু কিছু ঔষধ কী ঝুঁকি বৃদ্ধি করে?
হ্যাঁঃ ঔষধ সেবন স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যেতে হবে এবং শরীর ঠাণ্ডা রাখা এবং পানিশূন্যতা যেনো না হয় সেদিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
ডাইইউরেটিকস-এগুলোকে কখনো কখনো বলা হয় “ওয়াটার পিলস”। এ জাতীয় ঔষধ শরীর থেকে পানি নির্গমনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এগুলো হার্ট ফেইলিউরসহ ব্যাপক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। অধিক তাপমাত্রায় এ জাতীয় ঔষধ পানিশূন্যতার পাশাপাশি শরীরে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের তারতম্যের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
উচ্চরক্তচাপ বিরোধী ঔষধঃ এ জাতীয় ঔষধ রক্তচাপ কমায়। শরীরকে অধিক তাপমাত্রার সাথে খাপ খাওয়াতে এগুলো রক্তনালীকে সম্প্রসারিত করে এবং রক্তচাপ বিপদজনকভাবে কমিয়ে দেয়।
মৃগী এবং পারকিনসন্স রোগের কিছু কিছু ঔষধ শরীরের ঘাম বন্ধ করে দিতে পারে। এর ফলে শরীর ঠাণ্ডা হতে পারে না। এছাড়া অতিরিক্ত পানি শূন্যতা হয়ে থাকলে লিথিয়াম অথবা স্টাটিন্স জাতীয় ঔষধ রক্তকে ঘন করতে পারে এবং সমস্যার কারন হতে পারে।
শরীর ঠাণ্ডা রাখার কিছু টিপসঃ পানি পান করুন এবং প্রচুর পরিমানে পানি আছে এমন খাবার গ্রহন করুন। হ্যাট এবং ঢিলে ঢালা পোশাক পরিধান করুন যার মধ্যে দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হয়। ছায়ায় থাকার চেষ্টা করুন এবং ঘোরা ঘুরি ও ব্যায়াম কম করুন। শরীরের তাপমাত্রা কমাতে ফ্যান, বরফ এবং ঠাণ্ডা পানির ঝর্না ব্যবহার করুন।
অধিক তাপমাত্রা কী মৃত্যুর কারন হতে পারে?
হ্যাঁ।
ইংল্যান্ডে প্রতি বছর প্রায় ২০০০ মানুষ অধিক তাপমাত্রার কারনে মৃত্যুবরন করেন। বেশীরভাগ মৃত্যুই ঘটে থাকে হার্ট এটাক এবং স্ট্রোকে। তাপমাত্রা ২৫-২৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড অতিক্রম করলেই মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে, দেখা যায় গ্রীষ্মের সবচেয়ে বেশী তাপমাত্রার সময়টির চেয়ে বসন্তের তাপে অথবা গ্রীষ্মের শুরুতে মৃত্যু ঘটে থাকে। এর কারন হতে পারে গ্রীষ্মকাল আরম্ভ হওয়ার সময় আমরা আমাদের আচরন পরিবর্তন করি এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে থাকি।
বিগত সময়ের তাপদাহগুলো থেকে প্রমান মেলে যে খুব অল্প সময়ে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়-তাপদাহের প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই।
কীভাবে শরীরকে ঠাণ্ডা রাখবো?
নিশ্চিত করুন আপনি প্রচুর পানি অথবা দুধ পান করছেন। চা ও কফি পান করলেও চলবে। তবে, মদপান করার দিকে লক্ষ্য রাখুন কেনোনা অধিক মদ্যপান পানিশূন্যতার ঝুঁকি বাড়ায়।
যদি আপনার ঘরের চেয়ে বাইরের তাপমাত্রা অধিক হয়ে থাকে তবে ঘরের জানালা বন্ধ রাখুন এবং পর্দা নামিয়ে রাখুন।