
ম্যসসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল (এমজিএইচ)’র গবেষকরা একটি নতুন গবেষণায় জানতে পেরেছেন যে ভিটামিন ডি’র ঘাটতি ওপিঅইডের প্রতি আকর্ষণ এবং এটির উপর নির্ভরতা ও আসক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। সায়েস্ন এডভান্সেস নামক জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণার ফলাফল ভিটামিন ডি ঘাটতির সমস্যার সাথে সম্পৃক্ত সল্প মুল্যর সম্পূরক ঔষধ ওপিঅইডের প্রতি আসক্তির সমস্যার সমাধানে ভূমিকা পালন করতে পারে।
বর্তমান গবেষণার ভিত্তি রচনা করেন মাস জেনারেল ক্যান্সার সেন্টারের মেলানোমা প্রোগ্রামের পরিচালক ও এমজিএইচ এর কিউটানিয়াস বায়োলোজি রিসার্চ সেন্টার (সিবিআরসি)’র পরিচালক ডেভিড ই ফিসার। ২০০৭ সালে ফিসার ও তার দল অনাকাঙ্খিত একটি বিষয়ের সন্ধান পানঃ অতি বেগুনি রশ্নির প্রতি উন্মোচিত হলে আমাদের ত্বক এন্ড্রোফিন নামক একটি হরমোন উৎপন্ন করে যেটির সাথে মরফিন, হেরোইনসহ বিভিন্ন ওপিঅইডের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ সকল ওপিঅইড আমাদের মস্তিষ্কের একই ধরনের রিসেপ্টরদের সক্রিয় করে। ফিসারের পরবর্তী এক গবেষণায় দেখা যায় অতি বেগুনি রশ্নি ইঁদুরদের মধ্যে এন্ড্রোফিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং এর ফলে সৃষ্ট আচরনের সাথে ওপিঅইডের প্রতি আসক্তির মিল রয়েছে।
এন্ড্রোফিনকে কখনো কখনো বলা হয় “ভালো লাগানোর” হরমোন কেনোনা এটি এক ধরনের উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা যায় এর ফলে মানুষের মধ্যে সূর্যস্নানের এবং ট্যনিং সেলুনে যাওয়ার ইচ্ছার সৃষ্টি হয় যা কিনা ওপিঅইডের প্রতি আসক্তির মতই। ফিসার এবং তার সহযোগীরা মনে করেন নিজের অজান্তে এন্ড্রোফিনের অধিক মাত্রার কারনে মানুষ ইউভিবির প্রতি আকর্ষিত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে বৈপিরত্য রয়েছে। ফিসার বলেন “আমরা কেনো আচরনগতভাবে একটি কারসিনোজেনের প্রতি আকর্ষিত হবো?” সবকিছুর উপর এটি সত্য যে ত্বক কুচকানো অথবা ত্বকের অন্য যে কোন ক্ষতিই বলুন না কেনো ত্বকের ক্যান্সারের প্রধান কারন হলো সূর্যের আলো।
ফিসার বিশ্বাস করেন কেনো মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী সূর্যে আলোতে যেতে চায় তার একমাত্র ব্যাখা হচ্ছে যে আমাদের শরীরে ভিটামিন ডি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন ইউভি রশ্নি এবং এই ভিটামিন আমাদের শরীর নিজ থেকে উৎপন্ন করতে পারে না। ভিটামিন ডি আমাদের ক্যলসিয়াম গ্রহন কে উৎসাহিত করে যা কিনা হাড়ের গঠনের জন্য প্রয়োজন। প্রাগঐতিহাসিক সময়ে মানুষের দল যখন উত্তরে চলে যায় হয়তোবা বিবর্তনের একটি পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল যাতে করে মানুষ গুহা থেকে বের হয়ে ঠাণ্ডার দিনে সূর্য আলোকে তাপ গ্রহন করে। অনাথায় শিশুরা দীর্ঘ মেয়াদী ভিটামিন ডি’র অভাবে মৃত্যু বরন করতো (যা কিনা রিকেটের কারন) এবং শিকার থেকে পালানোর সময় মানুষ দুর্বল হাড়ের কারনে শিকারে পরিণত হতো।
এই তত্ত্বের কারনে ফিসার এবং তার দল অনুমান করে যে ভিটামিন ডি’র ঘাটতির কারনেই মানুষ সূর্যের আলো খুঁজে ফেরে যার মাধ্যমে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় হরমোনের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং ভিটামিন ডি’র ঘাটতির কারনে আমাদের শরীর ওপিঅইডের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে এবং আসক্তির কারন হয়। এমজিএইচের ডারমেটোলজির পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো এবং গবেষণা দলের অন্যতম লাজোস ভি কেমিনী বলেন “আমাদের লক্ষ্য ছিল আমাদের শরীরে ভিটামিন ডি’র প্রয়োজনীয়তার সাথে ইউভির প্রয়োজনীয়তা এবং ওপিঅইডের প্রতি আকর্ষণের মধ্যে যোগসুত্র খুঁজে দেখা”।
সায়েস্ন এডভান্সেস নামক জার্নালে ফিসার, কেমিনী এবং কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শী কয়েকটি দল এই প্রশ্নের উত্তর দুটি প্রেক্ষাপট থেকে খোজার চেষ্টা করেছে। একদিকে তাঁরা পরীক্ষাগারের সাধারন ইঁদুরগুলোকে তুলনা করেন সে সকল ইঁদুরদের সাথে যারা ভিটামিন-ডি’র সল্পতায় ভুগছিল (বিশেষ ব্রিডিং অথবা তাঁদের খাদ্য থেকে ভিটামিন ডি সরানোর মাধ্যমে)। কেমিনী বলেন “আমরা দেখেছি ভিটামিন ডি’র মাত্রা পরিবর্তনের সাথে সাথে ইউভি এবং ওপিঅইডের প্রতি আসক্তিজনিত আচরনের পরিবর্তন হয়।“ বিশেষ করে ইঁদুরগুলোকে যখন মাঝারি মাত্রার মরফিন প্রয়োগ করা হয় তখন ভিটামিন ডি’র সল্পতায় ভোগা ইঁদুরগুলো মরফিনের জন্য আসক্ত ছিল। এ ধরনের আচরন সাধারন ইঁদুরদের মধ্যে দেখা যায় না। যখন মরফিন প্রয়োগ বন্ধ করা হয়, ভিটামিন-ডি’র সল্পতায় ভোগা ইঁদুরগুলোর মরফিনের প্রতি আসক্তি দূর করাটা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল।
গবেষণায় আরো দেখা যায় যে, ভিটামিন-ডি’র সল্পতায় ভোগা ইঁদুরদের মধ্যে মরফিন একটি ব্যথানাশক হিসেবে কার্যকরভাবে কাজ করে। ফিসার বলেন এ সময়টায় এই ইঁদুরগুলোর মধ্যে ওপিঅইডের ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয় যা কিনা মানুষের বেলায় বেশ উদ্বেগজনক। ফিসার বলেন আমরা যদি একজন রোগীর কথা চিন্তা করি যার ভিটামিন ডি’র সল্পতা রয়েছে এবং যাকে অস্ত্রপচারের পর ব্যাথা নিবারনে মরফিন দেওয়া হয়েছে, তার ক্ষেত্রে মরফিনের উচ্ছাসজনিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবে ব্যাপক এবং ওই ব্যাক্তিটির আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেশী।
ভিটামিন ডি’র সল্পতা মানুষের আসক্তিমুলক আচরন বাড়িয়ে দেয় এমন তথ্যকে সমর্থন যুগিয়েছে বেশ কিছু সমসাময়িক বিশ্লেষণ। এগুলোর একটিতে দেখা যায় যে সব রোগীদের মাঝারি মাত্রার ভিটামিন ডি’র সল্পতা রয়েছে তাঁরা ওপিঅইডের স্বাভাবিক মাত্রার অন্যদের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশী এবং যে সব রোগীদের অধিক মাত্রার ভিটামিন ডির সল্পতা রয়েছে তাঁরা অন্যদের চেয়ে ৯০ শতাংশ বেশী আসক্তির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। অপর একটি বিশ্লেষণে দেখা যায় যাদের ওপিঅইড ইউজ ডিজ অর্ডার (ওইউডি) রয়েছে তাঁদের ভিটামিন ডি সল্পতায় ভোগার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশী।
ফিসার বলেন পরীক্ষাগারে একটি গবেষণার ফলাফল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। তিনি বলেন “আমরা যখন ভিটামিন ডি’র সল্পতায় ভোগা ইঁদুরদের ভিটামিন ডির মাত্রা সঠিক করে দেই ওপিঅইডের প্রতি তাঁদের আচরন উল্টে যায় এবং স্বাভাবিক হয়ে আসে। ফিসার লক্ষ্য করেন মানুষের মধ্যে ভিটামিন ডি’র অভাব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয় এবং এটি সল্প মূল্যর সম্পূরক ঔষধের মাধ্যমে সহজেই চিকিৎসা করা হয়। যদিও আরো অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে কিন্তু ফিসার মনে করেন ভিটামিন ডি’র সল্পতার চিকিৎসা ওইউডি’র ঝুঁকি কমাতে নতুন পথ দেখাতে পারে এবং এই অসুখের বর্তমান চিকিৎসায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। ফিসার বলেন “আমাদের প্রাপ্ত ফলাফল ইঙ্গিত করে যে জনস্বাস্থ্য খাতে ওপিঅইড মহামারী নিয়ন্ত্রনে হয়তো আমাদের একটি সুযোগ আসবে”।