
জুন ১১, ২০২১- নতুন এক গবেষণায় দেখা যায় যে প্রতিদিন দুটি করে ফল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ভালো তেমনি ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতেও সহায়ক।
অস্ট্রেলিয়ায় জনগণের উপর পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা যায় যে সব প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি দিনে দুটি ফল খেয়ে থাকেন তাঁদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দিনে একটি ফলের অর্ধেক খেয়ে থাকেন এমন ব্যাক্তিদের চেয়ে পাঁচ বছরের মধ্যে ৩৬% কম থাকে।
নিকোলা পি বোনডোন্নো এবং তার সহযোগীদের এই গবেষণার ফলাফল জুনের ২ তারিখ জার্নাল অফ ক্লিনিকাল এন্ডোক্রাইনোলজি এন্ড মেটাবোলিজমে প্রকাশিত হয়।
গবেষণায় আরো দেখা যায় যে বেশী ফল খাওয়ার সাথে ইন্সুলিনের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতার সম্পর্ক রয়েছে এবং এটি আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা কম রাখতে সহায়তা করে।
টকফল এবং কলা ব্যাতিত অধিক আপেল খেলেও তাতে ভাল ফল পাওয়া যায়।
এন্ডোক্রাইন সোসাইটির পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার পার্থের এডিথ কোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট ফর নিউট্রিশন রিসার্চের বোনডোন্নো বলেন “এর অর্থ যারা বেশী ফল খান (বিশেষ করে আপেল) তাঁদের রক্তের শর্করার মাত্রা কম রাখতে কম পরিমাণে ইনসুলিন উৎপাদন করতে হয়।
তিনি বলেন “এটি গুরুত্বপূর্ণ কেনোনা রক্তে অতি মাত্রায় ইনসুলিন (হাইপারইনসুলেমিয়া) রক্তনালীর ক্ষতি করতে পারে এবং এ কারনে শুধু ডায়াবেটিস নয় বরং উচ্চ রক্তচাপ, স্থলতা এবং হৃদরোগ হতে পারে।
ফলের রসে একই ধরনের উপকারিতা হয় না
বোনডোন্নো এক ইমেইলের মাধ্যমে জানান তাঁদের এই গবেষণা অস্ট্রেলিয়ান ফুড গাইডলাইনের সুপারিশকে সমর্থন করে অর্থাৎ দিনে দুটি করে ফল খাওয়ার অভ্যাস যেখানে একটি ফল হতে হবে ১৫০ গ্রাম ওজনের এবং তা হতে পারে এমেডিয়াম সাপ্পেল, কমলা অথবা কলা।
গবেষকরা বলেন ফলের রসের সাথে রক্তে শর্করার মাত্রা, ইনসুলিনের মাত্রার অথবা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমার কোন সম্পৃক্ততা নেই সম্ভবত ফলের রসে অতিরিক্ত চিনি থাকা এবং কিছু উপকারী আঁশ না থাকার কারনে।
তাঁরা বলেন “স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের (সবখানে পাওয়া যায় এমন ফল যেমনঃ আপেল, কমলা, কলা) সাথে সাথে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের অভ্যাস ডায়াবেটিসের (টাইপ ২ ডায়াবেটিস) ঝুঁকি কমাতেও পারে।
ডায়াবেটিসে ৫ বছরের ঝুঁকি কমানো
গবেষকরা বলেন এটি পরিষ্কার নয় যে ফল খেলে কিভাবে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে।
গবেষণায় অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে পাঁচ বছর এবং বারো বছর পর ফল এবং ফলের রস গ্রহনের সাথে রক্তে শর্করার মাত্রা, ইনসুলিন এবং ডায়াবেটিসের সম্পর্ক খতিয়ে দেখা হয় ।
তাঁরা ২৫ এবং এর অধিক বয়সী ৭৬৭৫ জন প্রাপ্ত বয়স্ককে শনাক্ত করেন যাদের ডায়াবেটিস হয়নি এবং তাঁরা রক্ত পরীক্ষা করিয়েছে এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে একটি খাদ্য সংক্রান্ত জরিপে অংশ নিয়েছেন।
অংশগ্রহণকারীরা জানান তাঁরা কতটা ঘন ঘন ১০টি বিভিন্ন ধরনের ফল, ফলের রস এবং অন্যান্য ধরনের খাবার খেয়ে থাকেন। একটি স্কেলে তাঁদের মেপে দেখা হয় যেখানে শূন্য অর্থাৎ কখনোই না এবং দশ অর্থাৎ দিনে তিন থেকে চারবার। এরপর গবেষকরা অংশগ্রহণকারীদের তাঁদের উত্তর অনুযায়ী বিভিন্ন দলে ভাগ করেন।

‘অতিরিক্ত চিনি’ কী?
বিভিন্ন খাবারে যেমনঃ ফল, সবজি, দুধ, পনির এবং এমনকি শস্যতে প্রাকৃতিকভাবে রয়েছে প্রচুর চিনি। তবে, বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত এবং পূর্বে প্যাকেটকৃত বিভিন্ন খাবারে (যেমনঃ আইসক্রিম, কুকিজ, ক্যন্ডি এবং সোডা থেকে আরম্ভ করে কেচাপ, স্পাগেটি সস, ইয়োগারট, রুটি এবং সালাদের ড্রেসিং) প্রস্তুতকারীরা বিভিন্ন ধরনের চিনি এবং সিরাপ যুক্ত করে থাকেন।

‘প্রাকৃতিক’ বনাম ‘অতিরিক্ত’ চিনি
সব খাবারেই কমবেশী প্রাকৃতিক চিনি রয়েছে। যেমনঃ একটি আপেলে প্রায় ২০ গ্রাম প্রাকৃতিক থাকতে পারে। তবে, এতে আমাদের শরীরের জন্য উপকারী ভিটামিন, মিনারেল এবং অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে। আপেলের আঁশ আপনার ক্ষুধা মেটানোর পাশাপাশি আপনার শরীরকে ফল থেকে চিনি ধীরে ধীরে শোষণে সহায়তা করে থাকে। অতিরিক্ত চিনিতে রয়েছে অতিরিক্ত ক্যলোরী তবে এতে কোন পুষ্টিকর উপাদান নেই। অতিরিক্ত চিনির কারনে আপনার ওজন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হতে পারে।

শরীরের ওজন
অতিরিক্ত ক্যলোরী আপনার শরীরে যেভাবেই প্রবেশ করুক না কেনো তা আপনার ওজন বৃদ্ধি করবে। তবে, আপনার খাবারে প্রচুর পরিমাণে অতিরিক্ত চিনি থাকলে তা সারাদিন আপনাকে বেশী পরিমাণে খেতে বাধ্য করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের খাবারের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত চিনিকে আপনি বিদায় জানাতে পারেন। এতে করে আপনার পেট খুব সহজেই ভরে যাবে এবং আপনাকে বেশী খেতেও হবে না।

ট্রাইগ্লিসারাইডসের ঝুঁকি কমানো
আপনার শরীরের ওজন যদি বেশী হয়ে থাকে তবে আপনার রক্তে কোলেস্টেরোলের (ট্রাইগ্লিসারাইডস সহ) মাত্রা বেশী থাকার সম্ভাবনা আছে। অতিরিক্ত চিনি এড়িয়ে চলতে পারলে আপনি ক্যলোরীর পাশাপাশি আপনার শরীরের ওজন কমাতে পারবেন এবং এর মাধ্যমে আপনার রক্তে কোলেস্টেরোলের মাত্রার উন্নতি হবে। তবে, শরীরের ওজন কমালেই সবকিছুর সমাধান হবে না। অন্যান্যদের মত শরীরের ওজন হলেও যারা অতিরিক্ত চিনি থেকে ক্যলোরীর পরিমান ২০% কমাতে পারেন তাঁদের রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডসের মাত্রাও কম থাকার সম্ভাবনা থাকে।

হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমান বেশী হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। কম পরিমাণে অতিরিক্ত চিনি গ্রহন করলে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমে এবং এর ফলে ওজন বৃদ্ধি বন্ধ হওয়া সহ হৃদরোগের সাথে সম্পর্কিত চর্বির পরিমানও কমে। আপনি যদি অতিরিক্ত চিনি হতে ২০%’র অধিক ক্যলোরী পেয়ে থাকেন তবে শরীরে ওজন বেশী না থাকলেও আপনি ঝুকিতে থাকবেন। তবে, অতিরিক্ত চিনি গ্রহন কমাতে পারলে আপনি হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারবেন।

উন্নত পুষ্টি
আপনার শরীরে ওজন যদি বেশী নাও হয়ে থাকে তাহলেও অতিরিক্ত চিনি কমালে আপনাকে উন্নত পুষ্টির কথা ভাবতে হবে যদি আপনি ফল, সবজি, বাদাম, মাছ এবং শস্য জাতীয় খাবারের মাধ্যমে অতিরিক্ত চিনিকে বিদায় দিতে চান। এ খাবার গুলোতে আপনার শরীরের সুরক্ষা এবং মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এ খাবারগুলোতে আঁশ থাকায় আপনার শরীর ধীরে ধীরে চিনি শোষণ করতে পারে এবং এতে করে আপনার রক্তে শর্করার পরিমান স্থিতিশীল থাকবে।

সুস্থ দাঁত
দাঁতে ক্ষয় সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া আপনার মুখে জন্মানোর পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে চিনি। এর ফলে আপনার দাঁতে ক্যভিটিসহ জটিল প্রদাহের সৃষ্টি হতে পারে। আপনি প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ ও ফ্লস না করলে অবস্থা আরো ভয়াবহ হতে পারে। আপনি যদি চিনি গ্রহন কমাতে পারেন বিশেষ করে অতিরিক্ত চিনি তবে আপনার দাতের ক্ষয় বন্ধ হবে অথবা কমবে।

রোগের সম্ভাবনা কমানো
যারা খাবারে অধিক পরিমানে অতিরিক্ত চিনি গ্রহন করেন তাঁদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, যকৃতের অসুখ এবং অন্যান্য শারীরিক জটিলতা হতে পারে। আপনি অতিরিক্ত চিনি কম গ্রহন করার মাধ্যমে এ সকল রোগের ঝুঁকি কমাতে পারেন। তবে, এটি পরিষ্কার নয় যে সমস্যার সৃষ্টিকারী কী অতিরিক্ত চিনি নাকি অতিরিক্ত ক্যলোরী। বিজ্ঞানীরা এখনও এই প্রশ্নের উত্তর খুজছেন।

কতটুকু আসলে অতিরিক্ত?
স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে অতিরিক্ত চিনি ১০ শতাংশের কম থাকে। অর্থাৎ আপনি যদি দিনে ১৮০০ ক্যলোরী গ্রহন করে থাকেন তবে অতিরিক্ত চিনির পরিমান প্রায় ১১ চা চামচ। অবশ্য কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন পরিমাণটি আরো কমঃ প্রতিদিন ৯ চা চামচ (৩৮ গ্রাম) পুরুষদের জন্য এবং ৬ চা চামচ (২৫ গ্রাম) নারীদের জন্য। একটি ১২ আউন্সের সোডার ক্যানে রয়েছে ৩৯গ্রাম (প্রায় ৯ চা চামচ) চিনি যা কিনা প্রায় একদিনের চিনির চাহিদার সমান।

অতিরিক্ত চিনির অনেক নাম প্রায় সব ধরনের প্যাকেট করা খাবারের তিন-চতুরথাংরশের ৫০টির অধিক নাম রয়েছে। তাই এদের মনে রাখাটাও বেশ কষ্টকর। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কর্ণ সিরাপ, হাই ফ্রুক্টস কর্ণ সিরাপ, অপ্রক্রিয়াজাত চিনি, আখের চিনি, আখের জুস, ডেক্সট্রোস, আগাভ, লাল চালের সিরাপ, কোকোনাট পাম সুগার, বারলি মাল্ট সিরাপ এবং আরো অনেক কিছু। আপনি কি কিনছেন এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইলে নির্ভরযোগ্য সুত্রে কোন পণ্যের তালিকা দেখে নিন।

অতিরিক্ত চিনি কিভাবে মাপবেন
খাদ্যের পুষ্টিগুনে চিনিকে দেখানো হয় মোট কার্বোহাইড্রেটের অধীনে। সাম্প্রতিক সময়েও হয়তো আপনাকে ভাবতে হয়েছে যে এগুলো কি অতিরিক্ত চিনি কিনা! কিন্তু বর্তমানে এফডিএ কে লেবেলের মাধ্যমে দেখাতে হয় ঠিক কতটুকু চিনি যুক্ত করা হয়েছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত কিছু ছোট কোম্পানী এই বাধ্যবাধকতা মেনে চলেনি। সুস্বাস্থ্যের জন্য মোট ক্যলোরীর পরিমান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিনি থেকেই হউক আর যে কোন খাবার থেকেই হউক অতিরিক্ত ক্যলোরী আপনার জন্য কখনোই মঙ্গলকর নয়।

কিভাবে অতিরিক্ত চিনি এড়িয়ে যাবেন
আপনি প্যাকেট করা খাবার এড়িয়ে খুব সহজেই অতিরিক্ত চিনিকে এড়িয়ে যেতে পারেন। এর পরিবর্তে তাজা ফল, সবজি, বীজ এবং বাদাম খেতে পারেন। পূর্বে প্রস্তুতকৃত খাবার কেনার সময় পুষ্টিগুন দেখে নিন। আপনি যদি জানেন খাবারটিতে কতটুকু চিনি রয়েছে আপনি কতটুকু খাবেন তা নির্ধারণ করতে পারবেন। সোডা এবং স্পোর্টস ড্রিংকস এর পরিবর্তে পানি পান করুন। এই জাতীয় কোমল পানীয়তে থাকা অতিরিক্ত চিনি পুষ্টি এবং ক্ষুধা নিবারনে বিভিন্ন কঠিন খাবারের চেয়েও খারাপ পরিনাম বয়ে নিয়ে আসতে পারে।
ক্রিস্টিন মিক্সটাস ৫/২৭/২০২১ এ রিভিউ করেনঃ
সবচেয়ে বেশী খাওয়া ফলের মধ্যে ছিল আপেল (মোট খাওয়া ফলের ২৩%)। এরপর ছিল কলা (২০%) এবং টক জাতীয় ফল (১৮%)। অন্যান্য বিভিন্ন ফল মোট খাওয়া ফলের ৮% কম ছিল বিধায় সেগুলোকে পৃথকভাবে নিরীক্ষা করা যায়নি।
যেসব অংশগ্রহনকারী কম ফল খেয়ে থাকেন তাঁদের তুলনায় যারা মোটামোটি এবং অধিক পরিমাণে ফল খেয়ে থাকেন তাঁরা ছিলেন মূল্ত নারী এবং সপ্তাহে তাঁরা অন্তত ১৫০ মিনিট ব্যায়ামের কথা জানান। এই দলে কম সংখ্যক ধূমপায়ী ছিলেন এবং যারা মোটামোটি থেকে বেশী পরিমান ফল খেয়ে থাকেন তাঁরা বেশী সবজিও খান এবং মাংস কম খান। গবেষণা অনুযায়ী তাঁরা বেশী চিনি গ্রহন করেন।
গবেষণায় অংশ নেয়া ৪৬৭৪ জনের মধ্যে যাদের ৫ বছর পর ফলো আপ করা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে ১৭৯ জনের ডায়াবেটিস হয়।
অংশগ্রহনকারীদের বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক পরিশ্রমের প্রবণতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, আর্থ সামাজিক অবস্থা এবং অন্যান্য বিষয় নির্ধারণের পর গবেষকরা দেখতে পান যে যারা কম ফল খেয়ে থাকেন তাঁদের তুলনায় যারা মোটামোটি পরিমাণে ফল খেয়ে থাকেন তাদের মধ্যে ৫ বছরের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৩৬% কম।
৩৫১৮ জন অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে যাদের ১২ বছর পর ফলো আপ করা হয় তাঁদের মধ্যে ২৪৭ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। তবে, সল্প সংখ্যক অংশগ্রহনকারীর কারনে এ ক্ষেত্রে ফল খাওয়া এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকির মধ্যে কোন যোগসুত্র পাওয়া যায়নি।