
আপনার যদি স্লিপ এপনিয়া থেকে থাকে তবে সম্ভবত আপনি এটি বুঝতে পারেন না। কিন্তু এই সমস্যাটির সাথে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং অন্যান্য অসুখের যোগসুত্র রয়েছে এবং এ কারনে আপনার জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
আফসানা বলছিলেন যে তাঁর মনে হয়েছিল যে তিনি মারা যাচ্ছেন। দিনের বেলায় তিনি এতোটাই ক্লান্ত ছিলেন যে তাঁর মনে হতো যেনো হাঁটু ভেঙ্গে পড়বে। গাড়ি চালানোর সময় তাঁর মাথা ঝিমিয়ে পড়ত এবং তারপর উনি টের পেতেন। তাঁর চোখে মুখে ছিল ক্লান্তির ছাপ।
রাতের বেলা তিনি ঘুমাতেন ভেঙ্গে ভেঙ্গে এবং তাঁর পা গুলো কামড়াত। তিনি হঠাৎ ঝাঁকি দিয়ে জেগে উঠতেন এবং নিঃশ্বাসের জন্য ছটপট করতেন। তাঁর বুক ধরফর করত।
আফসানার চিকিৎসক বিচলিত ছিলেন। তিনি কিছু রক্ত পরীক্ষা, ইসিজি করতে বললেন সম্ভবত হৃদরোগ সন্দেহে রাতের বেলা বুক ধরফরানির জন্য।
কিন্তু দেখা গেলো আফসানার হৃদযন্ত্র ভালো আছে এবং রক্তেও কিছু পাওয়া গেলো না।
এরপর চিকিৎসক কলোনোসকোপী করতে বললেন। সময়টা ছিল ২০০৮ সালের শেষের দিকে যখন আফসানার বয়স ছিল ৪৭ বছর। জ্ঞান ফেরার পর চিকিৎসক জানালেন আফসানার পায়ুপথে কোন সমস্যা নেই। অতএব কোন ক্যাস্নার নেই। এমনকি কোন পলিপ ও নেই।
এরপর আফসানার চিকিৎসক চিন্তা করলেন যে তাঁর স্লিপ এপনিয়া হতে পারে। আফসানা এই রোগের কথা কখনো শোনেনি।
আফসানা চিন্তিত হয়ে পড়লেন এই ভেবে যে তাঁর এমন কোন প্রানঘাতী অসুখ হলো কিনা যেটি এখনও গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। আফসানার দুশ্চিন্তা ছিল যে আমি এটা কিভাবে সামলাবো?
প্রথম রাতে সিপিএপি মেশিন ব্যবহার করে আফসানা বেশ ভালো বোধ করলো। জেগে উঠার পর বহু বছর পর আফসানা ছিল সতেজ ও প্রানশক্তিতে ভরপুর। সিপিএপি মেশিনের মাধ্যমে একটি সার্বক্ষণিক বায়ুর চাপ দেয়া হয়। এর অর্থ হচ্ছে আপনি শ্বাস নেয়ার সময় এবং ছাড়ার সময় বায়ু চাপ দিতে থাকবে। আপনাকে শ্বাস ছাড়ার সময় এই বাতাসের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। আপনার ঘুম ভেঙ্গে মনে হবে যেনো আপনার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আফসানার মুখ ছিল সিপিএপি মেশিনের মাস্ক দিয়ে আবৃত। যেটি থেকে বাতাস বের হয়ে তাঁর চোখ শুকিয়ে দিত বন্ধ থাকার পরও।
ঘুমের সময় আমাদের সময় তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হয়ে থাকে। ঘুমের বিভিন্ন ধাপ যখন আপনি অতিক্রান্ত করেন তখন আপনার শ্বাস প্রশ্বাস, রক্তচাপ এবং শরীরের তাপমাত্রা কমে যায় এবং বৃদ্ধি পায়। আরইএম নামক ধাপসমূহ (যা কিনা আমাদের ঘুমের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ হয়ে থাকে) ব্যাতিত আমাদের পেশীতে চাপ বেশীরভাগ সময় জাগ্রত অবস্থার মতই থাকে। আরইএম নামক ধাপে আমাদের বেশীরভাগ পেশীসমূহ অতিমাত্রায় শিথিল হয়ে যায়। তবে, যদি আপনার গলার পেশীগুলো খুব বেশী শিথিল হয়ে যায় তবে আপনার শ্বাস প্রশ্বাসের পথটি বাধাগ্রস্থ হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিকে বলা হয় অবসট্রাকটিভ স্লিপ এপনিয়া যা গ্রীক ভাষার এপনইয়া নামক শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ “শ্বাসরুদ্ধতা”।
স্লিপ এপনিয়ার ক্ষেত্রে বাতাসের সরবরাহ একটানা বাধাগ্রস্থ হয় যার ফলে আমাদের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। আপনি তখন নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য ছটপট করে থাকেন। এরকম পরিস্থিতি রাতে ঘুমের মধ্যে অনেকবার হতে পারে। এবং এর পরিনতি হতে পারে অনেক রকমের এবং ভয়াবহ তো বটেই। বিশ্বে প্রায় কয়েক কোটি মানুষ মৃদু হতে তীব্র স্লিপ এপনিয়ায় ভুগছেন।
এপনিয়ার কারনে আমাদের হৃদপিন্ডের উপর চাপের সৃষ্টি হয় কেনোনা আমাদের হৃদপিন্ডকে অক্সিজেনের ঘাটতি মেটাতে শরীরে দ্রুততার সাথে রক্ত সরবরাহ করতে হয়। রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা উঠা নামা করায় আমাদের শরীরের ধমনিসমূহে প্লাকের সৃষ্টি হয় এবং এ কারনে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি ইউএস ন্যশনাল কমিশন অন স্লিপ ডিজঅর্ডারস রিসার্চ অনুমান করে যে প্রতি বছর প্রায় ৩৮,০০০ আমেরিকান হৃদরোগে মৃত্যুবরন করেন এবং এর জন্য অনেকটাই দায়ী এপনিয়া।
এছাড়া এমনও প্রমান পাওয়া যায় যে এপনিয়ার কারনে আমাদের শরীরে শর্করার জারন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং এ কারনে শরীর ইনসুলিনের প্রতি প্রতিরোধী হয়ে উঠে যার কারনে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে এবং শরীরের ওজন বৃদ্ধি পায়।
এছাড়া কখনোই আপনি পুরোপুরি ঘুমাতে পারবেন না এবং এ কারনে ক্লান্ত বোধ করবেন। সেই সাথে আপনার স্মৃতিভ্রম ঘটতে পারে এবং আপনি হতাশা ও দুশ্চিন্তায় ভুগতে পারেন। নিদ্রাহীনতার কারনে অমনোযোগীতা ঘটতে পারে এবং এ কারনে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ২০১৫ সালে সুইডেনে গাড়ি চালকদের উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় যারা স্লিপ এপনিয়ায় ভুগছেন তাঁদের অন্যদের চেয়ে দুর্ঘটনায় কবলিত হওয়ার সম্ভাবনা ২.৫ গুন বেশী। অমনোযোগিতার কারনে এপনিয়ায় ভুগছেন এরকম অনেকে চাকরিচুত্য হয়েছেন।
অপর একটি গবেষণায় দেখা যায় যাদের তীব্র স্লিপ এপনিয়া রয়েছে তাঁদের অন্যদের চাইতে ১৮ বছর সময়ে মৃত্যুবরনের ঝুঁকি তিন গুন বেশী।
আমেরিকান একাডেমী অফ স্লিপ মেডিসিন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় প্রায় ১২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান স্লিপ এপনিয়ায় ভুগছেন যাদের মধ্যে প্রায় ৮০% মানুষের এই রোগ শনাক্ত হয়নি। ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা যায় বিশ্বব্যাপী প্রায় এক কোটি মানুষ মৃদু হতে তীব্র স্লিপ এপনিয়ায় ভুগছেন।
যদিও স্থুলতা, বর্ধিত ঘাড় অথবা টনসিল, ছোট চোয়াল অথবা বার্ধক্য স্লিপ এপনিয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে কিন্তু একজন মানুষ না ঘুমানো পর্যন্ত এই রোগটি হাজির হয় না। এই রোগ সনাক্তের একমাত্র উপায় হলো ব্যাক্তিটির ঘুম পর্যবেক্ষণ করা।
স্লিপ এপনিয়া আবিষ্কার হওয়ার পর প্রথম দশকে চিকিৎসার একটিমাত্র ব্যবস্থা ছিল। এটি হলো ট্রাকিওটোমি যার মাধ্যমে গলার নীচের অংশে ট্রাকেওসটোমি নামক একটি ছিদ্র করা হয় এবং এর মাধ্যমে আপনার ক্ষতিগ্রস্থ শ্বাস প্রশ্বাসের পথটিকে এড়ানো সম্ভব হয়। এর মাধ্যমে বেশ ভালো বোধ করলেও প্রক্রিয়াটির রয়েছে অনেক জটিলতা।
স্লিপ এপনিয়ার নতুন চিকিৎসার ক্ষেত্রে সিপিএপি নামক একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন সিডনী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক কলিন সালিভান। ট্রাইকিওটোমির জটিলতাগুলো তাঁকে এই যন্ত্র আবিষ্কারে উদ্বুদ্ধ করে।
১৯৮১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে তিনি এবং তাঁর দল বর্ণনা করেন কিভাবে তাঁরা পাঁচজন রোগীর নাকের উপর মাস্ক বসিয়েছিলেন। সিপিএপির মাধ্যমে শ্বাস প্রশ্বাসের পথের উপরিভাগের প্রতিবন্ধকতা পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব হয়।
তবে, ২০১২ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে জানা যায় প্রায় অর্ধেক সিপিএপি মেশিন ব্যবহারকারী প্রথম বছরের মধ্যে এটি ব্যবহার করা বন্ধ করেন।
নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভারসিটির ফিনবারগ স্কুল অফ মেডিসিনের সেন্টার ফর সিরকাডিয়ান অ্যান্ড স্লিপ মেডিসিনের পরিচালক ফাইলিস জি বলেন “যারা স্লিপ এপনিয়ায় ভুগছেন তাঁদের শনাক্ত করা জরুরী বিশেষ করে অস্ত্রপচারের সময় এই রোগটি ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে”। এবং এ কারনে অস্ত্রপচার পরবর্তী সময়ে ভালো ফল নাও আসতে পারে।
নাকডাকা এবং ক্লান্তি বোধ করার মত বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেনোনা সচেতনতা সৃষ্টিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের শত চেষ্টা সত্ত্বেও বেশীরভাগ মানুষ বুঝতে পারেন না যে তাঁদের স্লিপ এপনিয়া হয়েছে।
এরপরও স্লিপ এপনিয়ার চিকিৎসার খরচ এবং সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে কমে আসায় আমরা আশা করতে পারি আরো অধিক সংখ্যক মানুষ বুঝতে পারবেন যে তাঁদের এপনিয়ার সমস্যা রয়েছে। এই রোগ সনাক্তের জন্য পরীক্ষাগারে পরিচালিত পলিসমনোগ্রামের অধিক খরচ ও দীর্ঘসুত্রিতাকে বলা যায় এই রোগ শনাক্ত হওয়ার পেছনে অন্যতম কারন।
জনস হপকিন্স স্কুল অফ মেডিসিনের মেডিসিনের অধ্যাপক এবং ফুসফুসের রোগ ও স্লিপ এপনিয়া বিশেষজ্ঞ ফিলিপ স্মিথ বলেন “ওজন কমাতে পারলে এই রোগ নিরাময় সম্ভব। তবে সমস্যা হলো যে মানুষ সেটা পারেনা”।
তবে, সিপিএপি যন্ত্র ব্যবহারে অসুবিধার কারনে বিগত দুই দশকে স্লিপ এপনিয়ার বেশকিছু নতুন চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়েছে।
৯০’র দশকের মধ্যবর্তী সময়ে দাঁতের এক ধরনের যন্ত্র স্লিপ এপনিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহার করা আরম্ভ হয়। এর মাধ্যমে জিহবাকে সরিয়ে রাখা হয় যাতে করে বাতাস প্রবেশ করতে পারে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে নীচের চোয়ালকে জিহবা সহ সামনের দিকে নিয়ে আসা হয়।
তবে, সিপিএপির মত এই যন্ত্রটিও স্লিপ এপনিয়ার চিকিৎসায় খুব একটা কার্যকর হয়নি। কারন এর মাধ্যমে চোয়ালটিকে অস্বস্তিকর অবস্থানে নিয়ে আসা হয় এবং এ কারনে দীর্ঘ দিন ব্যবহার করলে চোয়াল সামনে এগিয়ে থাকায় আপনার কামড়াতে অসুবিধা হতে পারে। এছাড়া যন্ত্রটির প্রয়োগকৃত চাপের কারনে আপনার দাঁতের অবস্থানেরও সামান্য পরিবর্তন হতে পারে।
তবে, এ জাতীয় সমস্যা খুব কম হয়ে থাকে। কারো যদি তীব্র স্লিপ এপনিয়া থেকে থাকে তবে তাঁকে সিপিএপি মেশিন ব্যবহার করতে বলা হয়।
তবে, যে সকল রোগী সিপিএপি মেশিন এবং দাঁতের যন্ত্রটি ব্যবহার করতে পারেন না তাঁদের এক ধরনের অস্ত্রপচার করা হয়ে থাকে এবং এর মাধ্যমে গলার কোষগুলোকে উন্মুক্ত করা হয়।
এছাড়া হাইপোগ্লোসাল নার্ভ স্টিমুলেশন (এইচএনএস) নামক একটি যন্ত্র ব্যবহার করা হয়ে থাকে যার মাধ্যমে বৈদ্যুতিক শকের মাধ্যমে জিহবাকে সংকুচিত করা হয় এবং ঘুমের মধ্যে জিহবা যেনো পেছনে চলে না আসে সেটি নিশ্চিত করা হয়।
স্লিপ এপনিয়ার অনেক ধরনের চিকিৎসা রয়েছে এবং সবগুলোরই কিছু না কিছু খারাপ দিক রয়েছে। তবে, কোন রোগীর ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা কার্যকর সেটি বলা মুশকিল।
তবে, জনস হপকিন্সের স্মিথ বলেন “স্লিপ এপনিয়ার চিকিৎসার ভবিষ্যৎ রয়েছে নিউরোকেমিক্যালে। আমরা ইদুরের মধ্যে এপনিয়ার চিকিৎসা করতে পারছি। সম্ভবত আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে আপনারা স্লিপ এপনিয়ার ঔষধ পেয়ে যাবেন কেনোনা এটি একটি নিউরাল-ক্যমিকাল সমস্যা। এটি বলা যায় না যে শুধুমাত্র স্থুলতা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী তবে চর্বি থেকে নিঃসৃত কিছু হরমোনের জন্যও আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের পথটি অকার্যকর হয়ে যায়। আবার অনেক বিশেষজ্ঞ এটিকে দুটি কারনের সমষ্টিও মনে করেন এবং তাঁরা চর্বি থেকে নিঃসৃত কিছু হরমোনের বিষয়ে গবেষণা করছেন। স্লিপ এপনিয়াকে ঘিরে আরো আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এটোমোক্সেটাইন এবং অক্সিবুটাইনিন নামক দুটি ঔষধ ব্যবহার করে দেখা গিয়েছে যে এগুলো অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশের ঘুমের মধ্যে নিঃশ্বাসহীনতা দূর করার মাধ্যমে বেশ ভালোভাবেই এপনিয়া কমাতে সহায়ক।